সোমনাথ লাহা: পলাশের রঙে সূর্যের প্রথম আলোর মিশেল আর ভোরের হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে একে একে সিউড়ি, কচুজোড় পার হয়ে আমরা যখন চিনপাই স্টেশনে নামলাম, ঘড়ির কাঁটা তখনও সাত ছোঁয়নি। সবুজ, শান্ত, ছোট্ট স্টেশনটা ভেদ করে ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর দেখলাম, পড়ে আছি আমরা হাতে গোনা ক’জন-যাঁদের অধিকাংশই মনে হল রুটিরুজির সন্ধানে। সঙ্গী অরিন্দমকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী তলার ‘বড়মা’-কে দর্শন করে আমাদের তিনচাকার ব্যাটারিচালিত বাহন বাঁধেশোল হয়ে এবার এসে পৌঁছাল লাল মোরাম বিছানো রাস্তাটার একেবারে শেষ প্রান্তে। একটা ভাঙা গেট, বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু অর্ধনির্মিত পরিকল্পনার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া সেরকম আর কিছুই নেই চোখে পড়ার মতো।
বোটম্যান তথা আমাদের আজকের সফরসঙ্গী বিষণ বাউড়ি নৌকা নিয়ে এসে পৌঁছালেন যথাসময়েই। জায়গাটার নাম কেন যে ‘নীল নির্জন’, সে বিষয়ে একটা কৌতূহল আগে থেকেই ছিল। শান্ত, নীল জলরাশিতে নৌকাবিহার করতে করতে সেই নির্জনতাতেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম যেন। কাছে-দূরে কেউ কোত্থাও নেই। বীরভূম জেলার অন্তর্গত বক্রেশ্বর নদীর ধারে অবস্থিত নীল নির্জন রিজার্ভার। পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়ে থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। শীতের সময় অনেক পিকনিক পার্টি আর পরিযায়ী পাখি দেখতে ভিড় করা বড় ক্যামেরার মানুষজন এখানে আসে। কিন্তু এখন পরিবেশটা একেবারেই আলাদা। গোপালপুর, রাধামাধবপুর, মণিরামপুরের মতো বেশ কিছু গ্রামের অধিগৃহীত জমিতে গড়ে ওঠা প্রায় সাতাশশো একর এই জলাশয় সত্যিই আজ নির্জন। নিঃসঙ্গতার আবহে বহমান।
[আরও পড়ুন: চা বাগিচার বুক চিরে ইতিহাসের কাছাকাছি, ঘুরে আসুন গুপ্তেশ্বর মন্দির]
দূরে একঝাঁক কমন-কুটের সঙ্গে গোটা ছয়েক টাফটেড ডাক, কিছু রুডি শীলডাক আর কটন পিগমি হাঁস জলকেলি করছে। ময়ূরাক্ষীর শাখানদী বক্রেশ্বর ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা থেকে উৎপন্ন হয়ে বীরভূম জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোপাইয়ের সঙ্গে মিশেছে। এই বক্রেশ্বর নদীতেই বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা বীরভূম জেলার এই কৃত্রিম জলাধার বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা ছাড়াও শীতে হয়ে ওঠে অনেক পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
আমাদের নৌকা এখন যে অভিমুখে চলেছে, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে বড় একঝাঁক বার হেডেড গুজ। জলাশয়ের নীল জলে ওদের সাদা সাদা মাথা আর তার উপর কালো দুটো দাগ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে চোখের সামনে। প্রায় একুশ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম এই ‘বড়ি হাঁস’-কে (দাগি রাজহাঁস বলেও অনেকে চেনেন) এভারেস্ট পাহাড়ের উপর দিয়েও উড়তে দেখা গিয়েছে বলে শোনা যায়।
দূরে চোখ পড়ল একটা ওস্প্রে পাখি জলের মাঝখানে আধখানা একটা তালগাছের উপর এসে বসল। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখলাম কোনও মাছ শিকার করেছে কি না! নিশ্চিত হয়ে আবার বার হেডেডেই মনোনিবেশ করলাম। বোটম্যান বাউড়িমশাই জানালেন, এরা প্রধানত রাতের বেলাতেই খাবার খায় এবং পার্শ্ববর্তী জমির ফসলের বেশ ক্ষতিও করে। এদিকে রোদের তেজও বাড়ছে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। পাশেই চোখ পড়ল একটা পলাশ গাছের দখল নিতে আসা শামুকখোল আর পার্পল হেরনের ছোট্ট দ্বৈরথ। অদূরেই শুকনো একটা ডালে বিশ্রাম নিচ্ছে একটা গ্রেটার স্পটেড ঈগল।
[আরও পড়ুন: বাজেটের মধ্যে ওয়েডিং ডেস্টিনেশন খুঁজছেন? নজরে রাখতে পারেন এই জায়গাগুলি]
কিন্তু যাকে দেখতে পাওয়ার সুপ্ত আশা নিয়ে এই সাতসকালে নির্জনতায় ডুব দেওয়া, সেই পায়েড-হেরিয়ারের পুরুষ প্রকার এবারও থাকল অধরা। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বনদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এই এলাকা হয়ে উঠতেই পারত বা পারে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভয় হয় পাখিদের এই নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব হ্যাবিট্যাট তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তো? তার চাইতে বরং নির্জনতাই সঙ্গী হয়ে থাক না দূরের পরিযায়ীদের।
কীভাবে যাবেন
অন্ডাল-সাঁইথিয়া ট্রেন শাখায় চিনপাই স্টেশন বা পানাগড় -মোরগ্রাম সড়কে বাঁধেশোলে নামতে হবে। আশপাশে কোনও দোকানপাট নেই। সঙ্গে খাবার নিয়ে যাওয়াই ভাল। যানবাহনের ব্যবস্থাও সীমিত। এখানে যাওয়ার জন্য সঙ্গে গাড়ি থাকা প্রয়োজন।
ছবি: প্রতিবেদক
The post সপ্তাহান্তে কাটান নীল নির্জনে পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে appeared first on Sangbad Pratidin.