বিশ্বদীপ দে: জীবন ও মৃত্যুর সীমান্তরেখা বরাবরই আকর্ষণ করে এসেছে মানুষকে। আসলে ‘জীবন এত ছোট কেনে’, এ তো কেবল তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের শেষ বাক্য মাত্র নয়। এর মধ্যে ধরা রয়েছে মানব সভ্যতার চিরকালীন আক্ষেপের সারাৎসার। যদিও তা জাগতিক মোহমায়ায় ডুবে থাকা মানুষের মনের কথা বলেই আপাতভাবে মনে হয়। পাশাপাশি প্রশ্ন জাগে, সন্ন্যাসী তো নিজেকে মুক্ত করে ফেলেন সব কিছু থেকে। কিন্তু তা বলে মৃত্যুর পরেও কোনও ভাবে এই সংসারের বুকে থেকে যাওয়ার এক আকাঙ্ক্ষা কি তাঁর মনের মধ্যেও জেগে থাকে না? জাপানের (Japan) বৌদ্ধ (Buddhist) সন্ন্যাসীরা নিজেই নিজের দেহটিকে মমি বানিয়ে রাখার এক রোমাঞ্চকর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতেন। সেকথা ভাবতে বসলে এই প্রশ্নও ফের নতুন করে জেগে উঠতে থাকে।
কেবল জাপান নয়, চিন-সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এর প্রচলন ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি এই রীতির দেখা মিলবে জাপানের উত্তরে অবস্থিত ইয়ামাগাতা (Yamagata) শহরের ইতিহাস খুঁড়লে। একাদশ থেকে শুরু হয়ে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রমরম করে চলেছিল এই রীতি। কিন্তু এরপরই জাপানের সরকার এটি নিষিদ্ধ করে দেয়। সরকারের মত ছিল, এটা এক ধরনের আত্মহত্যা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার পরেও এই রীতি একেবারে গায়েব হয়ে যায়নি। বারে বারে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা হেঁটেছেন নিজেই নিজেকে মমি করে রাখার দুরূহ পথে। তাঁরা মোটেই মানতেন না, এটা কোনও আত্মধ্বংসের প্রক্রিয়া।
[আরও পড়ুন: স্বামীকে চেনে বেঁধে কুকুরের মতো রাস্তায় ঘোরাল স্ত্রী! কারণ জানলে অবাক হবেন]
মমি বললেই সবার আগে মিশরের কথা মনে পড়ে। তার সঙ্গে কিন্তু কোনও মিলই নেই জাপানের এই সন্ন্যাসীদের (Buddhist monks) মমির। ধনী ফারাওদের মৃত্যুর পরে সেই দেহটিকে রাসায়নিক মাখিয়ে প্রস্তুত করা হত, যাতে পচন না ধরে। কিন্তু এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এমন আত্মমমিকরণের পদ্ধতি জানতেন, যাতে জীবিত অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হওয়া যায় মমিতে। একসময় শরীর নিষ্প্রাণ হয়ে আসত। বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ধরে নেওয়া হত, তাঁরা আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন। তখন তাঁরা ‘সোকুশিনবুৎসু’।
কিন্তু কীভাবে নিজেদের দেহকে মমিতে পরিণত করতেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা? সে পদ্ধতি কম রোমাঞ্চকর নয়। এর জন্য যে ডায়েট চার্ট তাঁদের মেনে চলতে হত, তা রীতিমতো কঠোর। আগেই বলা হয়েছে, সেই পদ্ধতি বেশ ধীরগতির। প্রথমে অন্য সমস্ত ধরনের খাওয়াদাওয়া ছেড়ে কেবল জল, ফলমূল, বাদাম – এই সব খেতেন তাঁরা। এর ফলে মেদ ঝরিয়ে ক্রমেই রোগা হয়ে যেত শরীর। পরের ধাপে সেসবও খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। তখন কেবল পাইন গাছের শিকড় ও ছালবাকল। আর সেই সঙ্গে এক বিশেষ ধরনের চা। যা তৈরি হত বার্নিশ গাছের বিষাক্ত রস দিয়ে। এই চা সন্ন্যাসীদের শরীরকে যে কোনও রকম জীবাণুর সংস্রব থেকে মুক্তি দিত। মৃত্যুর পরেও সেখানে ঘেঁষতে পারত না ম্যাগট। ফলে দেহও পচত না।
[আরও পড়ুন: বরফঢাকা শ্রীনগরে ঘোড়ায় সওয়ার আমাজনের ডেলিভারি বয়, ভিডিওয় মুগ্ধ নেটিজেনরা]
শেষে যখন শরীর একেবারে মৃতপ্রায়, তখন সেই শরীরকে মাটির নিচে এক কক্ষে রেখে দেওয়া হত। সেই কক্ষের ভিতরেই পদ্মাসনে সমাধিস্থ হয়ে থাকতেন মমি হতে যাওয়া সন্ন্যাসী। একটি বাঁশের চোঙার সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতেন তিনি। ওই কক্ষে থাকত একটি ঘণ্টা। রোজ সেই ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের বেঁচে থাকার সংকেত দিতেন সন্ন্যাসী। একসময় আর ঘণ্টা বাজত না। তখন সবাই বুঝতে পারত, তিনি আর বেঁচে নেই।
এরপর সেই বাঁশের চোঙা সরিয়ে নিয়ে কক্ষের মুখ বন্ধ রাখা হত এক হাজার দিনের জন্য। এক হাজার দিনের পরে দেখা হত সেই সন্ন্যাসী মমি হয়ে গিয়েছেন কিনা। পদ্ধতি সফল হলে সেই দেহ তুলে এনে তাঁকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হত। তবে সবসময় প্রক্রিয়া সফল হত না। দেখা যেত, কোনও কোনও দেহে পচন ধরেছে। সেই দেহগুলি কবর দিয়ে দেওয়া হত। দেখা গিয়েছে, এঁদের সংখ্যাই বেশি।
আর যাঁরা মমি হয়ে যেতেন? বৌদ্ধরা মনে করেন, তাঁরা আসলে ধ্যানমগ্ন। সুদূর ভবিষ্যতে কোনও এক সময়ে আবার তাঁরা জেগে উঠবেন। পথ দেখাবেন নির্বাণের! কোনও কোনও মতে, এই ধরনের ‘লিভিং বুদ্ধা’-র সংখ্যা মাত্র ২৪টি। আবার কারও মতে, সংখ্যাটা অনেক বেশি। কিন্তু তাঁরা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। আজ জাপানে গেলে এমন মমি মাত্র কয়েকটিই দেখতে পাওয়া যাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মমিটি শিন্নোকাই-শনিনের। ১৬৮৭-তে তাঁর জন্ম। ৯৬ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মমি হওয়ার। দৈনিচি-বু মন্দিরে রয়েছে তাঁর মমি। সবচেয়ে তরুণ মমিটি ১৯০৩ সালের। বুক্কাই নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর। ১৯৬০ সালে বিশেষজ্ঞরা তাঁর দেহ পরীক্ষা করে চমকে উঠেছিলেন। এমনই চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত রয়েছে সেটি।
আজ এসবই ইতিহাস। অতীতের গর্ভে আশ্রিত ‘সোকুশিনবুৎসু’-রা। কিন্তু সেই ফেলে আসা সময়ের মানুষদের দেখতে আজও জাপানের মন্দিরে ভিড় জমান মানুষেরা। মানুষের কৌতূহল ঠিকরে ওঠে এমন মমিদের সামনে দাঁড়ালে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে অবশ্য তাঁরা মমি নন, মৃত্যুঞ্জয়ী অমর! মনে পড়ে যায় বহুল প্রচলিত প্রবাদটি। বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু…। কিন্তু তেমন বিশ্বাসের শরিক নন, এমন মানুষও চরম কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকেন ‘লিভিং বুদ্ধা’-দের দিকে। তাঁদের রোমাঞ্চকর অনুভবে তাঁরা দেখতে পান সুদূর অতীতের এক জলছবি। নির্জন কক্ষের মধ্যে অপেক্ষা করছেন শীর্ণকায় মৃতপ্রায় এক প্রাণ। সঙ্গে কেউ নেই তাঁর, কেবল একটিমাত্র বাঁশের চোঙা ও ঘণ্টা ছাড়া।