সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: উৎসবের আয়ু ধীরে ধীরে কমছে। শেষের পথে বাঙালির সেরা উৎসব। কিন্তু আনন্দের কি আর শেষ আছে? তাই তো বিসর্জনের বিষাদেও ব্যতিক্রমী নিয়ম পালন করে নব আনন্দে মেতে ওঠেন পুরুলিয়ার ঝালদার রাজপরিবার সংলগ্ন এলাকাবাসী। দশমীর ঘট বিসর্জনের পরই রাজপাগড়ি বাঁধা ‘একদিনের রাজা–রানি’কে দর্শন করেন প্রজারা। আজ রাজতন্ত্রের অবসানেও, ঝালদার হেঁসলা রাজপরিবার যেন ইতিহাসের স্পর্শ পায়। পর্দানসীন থাকা রানি মা ও রাজার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তাঁদের হাত থেকে মন্ডা–মিঠাই নেওয়ার পরই এই এলাকায় শুরু হয় বিজয়া।
[ আরও পড়ুন: পুজোয় অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পে নতুন জামাকাপড়, তবু ম্লান দুর্গোৎসব]
ইতিহাস বলছে, রাজস্থানের যোধপুর থেকে দিগ্বিজয় প্রতাপ সিং দেও আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে ঝালদার ইলুতে পা রাখেন।তখন সেখানেই ছিল রাজবাড়ি। পরবর্তী সময়ে হানাদারদের আক্রমণে এই রাজপরিবার দিশেহারা হয়ে যায়। তারপর হেঁসলাতেই শুরু হয় রাজপাট। এই রাজপরিবারের পুজোয় দশমীর ঘট বিসর্জনের পর ‘রাজা–রানি’র দর্শন করার রেওয়াজ চালু হয় ইলুতে রাজত্ব থাকার সময় থেকেই।
দশমীর ঘট জলাশয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার পরই দুর্গা মন্দিরে পা রাখেন রাজপরিবারের সদস্যরা। রীতি অনুযায়ী, সেখানেই এই রাজপরিবারের উত্তর পুরুষ কন্দর্পনারায়ণ সিং দেওকে কলা বউয়ের শাড়ি নিয়ে পাগড়ির মত করে তাঁর মাথায় বেঁধে দেন রাজপুরোহিত। কলা বউ এই রাজপরিবারে ‘মান ঠাকুরন’ নামে পরিচিত। এমনকী মা দুর্গার গলায় থাকা বেলপত্র-সহ নানান মালা ওই উত্তর পুরুষের গলায় পরানো হয়। আজকাল তাঁকে ‘একদিনের রাজা’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয় তামাম হেঁসলা পরিবার। সেখানে রাজপুরোহিত শান্তি জল ছেটানোর পর সিদ্ধি যাত্রা করেন তিনি। রামচন্দ্র যেভাবে বিজয় যাত্রা করেছিলেন, সেইভাবেই পূর্ব–পশ্চিম–উত্তর–দক্ষিণ দিকে রাজপুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে আড়াই পা করে এগিয়ে যান।
সে এক দৃশ্য বটে! তারপরই ‘একদিনের রাজা’কে ঢাক, ঢোল বাজিয়ে কীর্তনের মাধ্যমে দুর্গামন্দির থেকে ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এই ঠাকুরবাড়িতেই রয়েছে রাধাকৃষ্ণ, শিবের বিগ্রহ। এখানেই পর্দার আড়ালে সারা বছর থাকেন রানি মা। তবে দশমীতে তাঁর দর্শন লাভ করেন প্রজারা। রাজা কন্দর্পনারায়ণ সিং দেও সেখানে পা রেখেই তাঁর মাথায় থাকা পাগড়ি তাঁর স্ত্রী তথা রানি মা অনিতা সিং দেওর মাথায় পরিয়ে দেন। শুরু হয়ে যায় ‘একদিনের রাজা–রানিকে’ পা ছুঁয়ে প্রণাম।
[ আরও পড়ুন: অম্লান ঐতিহ্য, নবদ্বীপে বৈষ্ণব মতে হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পুজো]
রাতে দেবী দুর্গাকে এলাকার মানুষজন কাঁধে বহন করে নিয়ে যান জলাশয়ে। মূর্তি বিসর্জন দেওয়ার পর রাজপরিবারের তরফে চলে মন্ডা–মিঠাই বিলি। শুরু হয় বিজয়া। সেই ‘একদিনের রাজা’ কন্দর্পনারায়ন সিং দেও বলেন, ‘বয়স্ক মানুষজনও আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন। এই বিষয়টি আমার ভাল না লাগলেও, তাঁদের নিষেধ করে কোনও কাজ হয় না।’ তাই পাশাপাশি বসে থাকা ‘একদিনের রাজা–রানি’র আশীর্বাদ নিতে বিজয়ার রাতেই ঢল নামে হেঁসলায়। যেন শুরু হয়ে যায় আরেক উৎসব।
ছবি: সুনীতা সিং।
The post একদিনের ‘রাজা-রানি’ দর্শন, দশমীর পর ঝালদার রাজবাড়িতে শুরু অন্য উৎসব appeared first on Sangbad Pratidin.
