সুলয়া সিংহ: রাজনীতির জগতের ভাষায় আছে, দিল্লির রাস্তা লখনউ হয়ে যায়। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের ছবিই যেন স্পষ্ট করে দেয় রাজধানীর কুর্সিতে আসীন হবেন কে। সেই রাজপথের অন্যতম জংশন বারাণসীও। ২০১৪ সালে ঐতিহ্য, ধর্ম আর ইতিহাসে মোড়া এই শহরের ভোটারদের মন কেড়ে নেন নরেন্দ্র মোদি। তবে তার অনেক আগে থেকেই গঙ্গার ঘাটের আশপাশে পদ্মফুলেরই বাস। গত চার-পাঁচ বছরে মোদির হাত ধরে নানা পরিবর্তন দেখেছে কাশী বিশ্বনাথের শহর। সে বদলে কি খুশি বারাণসীর বাসিন্দারা? নাকি প্রধানমন্ত্রীর ‘আপন দেশে’ নিয়মকানুন হয়ে উঠেছে সর্বনেশে! সে উত্তর খুঁজতেই ভোটের আগে হাওড়া থেকে বিভূতি এক্সপ্রেসে চেপে বসা। ভারতবাসীর গর্বের শহরকে আরও একটু কাছ থেকে দেখে যা মনে হল, তা খানিকটা এরকম…।
এককালে বারাণসীকে (Varanasi) বাঙালির সেকেন্ড হোম বলা হত। বিশ্বনাথধামে গিয়ে সেই বাঙালিয়ানার ছোঁয়া পেতে গদোলিয়া মোড় থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট পৌঁছনোর ঠিক আগে ডানদিকের সরু গলি দিয়ে বাঙালি টোলায় ঢুকে পড়া। নতুন করে মন্দির তৈরির আঁচ অবশ্য সেই অলি-গলিতে পড়েনি। তবে বাঙালি টোলায় ঢুকে এ শহরকে বাঙালির সেকেন্ড হোম বলতে দ্বিধাবোধ হচ্ছে। বাঙালির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। বাপ-ঠাকুরদারা প্রয়াত হওয়ার পর নয়া প্রজন্মের ছেলেপিলেরা ভিটে বিক্রি করে শহর ত্যাগ করেছেন। অনেক বাড়ি আবার খাঁ খাঁ করছে। প্রয়োজনীয় নথির অভাবে বিক্রি করা যায়নি সেসব বাড়ি। পূর্বপুরুষরা আর নেই। তাই সেসব বাড়ি এখন পোড়ো বাড়ির আকার নিয়েছে।
গলির প্রায় সব বাঙালি ভাতের হোটেলগুলোরও একই হাল। করোনার জেরে পর্যটকদের সংখ্যা কম। তাই অনেক রেস্তরাঁতেই চিরতরে তালা পড়েছে। এরই মধ্যে বাঙালি খাবারের খোঁজ পাওয়া গেল ‘বাবা’ রেস্তরাঁয়। তবে এখানেও আর নিয়মিত মাছ-মাংস-ডিম রান্না হয় না। আগে থেকে বলে রাখলে তবেই কব্জি ডুবিয়ে মুরগির ঝোল খাওয়া যাবে। বললেন, রেস্তরাঁর মালিক নিতাই। কোভিড আবহে (Corona Pandemic) পর্যটকের আনাগোনা কমে যাওয়ায় কমেছে আয়। আর বেড়েছে খরচ। বছর ষাটের নিতাইবাবুর পৈতৃক ভিটে কৃষ্ণনগরে। ১১ বছর বয়স থেকে এ শহরের বাসিন্দা। বলছিলেন, গত কয়েক মাসে যেভাবে গ্যাসের দাম বাড়ছে, তাতে রেস্তরাঁ চালানোই কঠিন হয়ে উঠছে। তাছাড়া পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাজারেও আগুন। সাধারণ মানুষের কথা যেন ভাবাই হয় না। ‘আচ্ছে দিনে’র আশা নিয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিলেন আমজনতা। কিন্তু কোথায় কী! প্রতিশ্রুতি কেবল প্রতিশ্রুতি হয়েই থেকে গিয়েছে। সেই বিজেপি এখন ভোটপ্রচারের মূল হাতিয়ার করেছে ধর্মকে। নিতাইবাবুর কথায়, “শুধু ধর্ম দিয়ে তো পেট চলবে না। খাবার চাই।” তাহলে এবার কী করবেন ভাবছেন? এক মুহূর্ত না ভেবেই তিনি বলে দিলেন, বিজেপিকে সুযোগ দিয়ে তো দেখলাম। এবার না হয় অখিলেশজিকে দিয়েই দেখা যাক। তবে মায়াবতীজিকে কোনও সুযোগ দেওয়া যাবে না। উনি মুখ্যমন্ত্রী হলে আবার হাতি-ঘোড়ার মূর্তি তৈরি করা শুরু করবেন! বোঝা গেল, গেরুয়া দেওয়ালের ফাঁক গলে বাঙালি টোলাতে ফের শুরু হয়েছে ‘সাইকেলে’ই আনাগোনা।
[আরও পড়ুন: ‘পুরো নরক, ফিরতে পারব না মনে হচ্ছিল’, ইউক্রেন থেকে ফিরেও আতঙ্কে ভারতীয় পড়ুয়া]
পোনা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খেতে এসব আলোচনার মাঝেই মনটা ‘পান পান’ করে উঠল। বাঙালি টোলার গলি থেকে বেরিয়ে আসতেই মন্দিরের ২ নম্বর গেটের উলটো দিকে পরপর পানমশলার দোকান চোখে পড়ল। বেশিরভাগের নামই বড় বড় করে বাংলায় লেখা। আলাপ হল প্রতীকের সঙ্গে। ছেঁচা পান খাইয়ে বললেন, ”গরম পড়লেই দোকানে ফ্যান চালাতে হবে। আর তাতে খরচ আরও বাড়বে।” এখন নাকি বারাণসীতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। ইলেকট্রিক বিল দেখলেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। অথচ আয় কোনও অংশে বাড়েনি। প্রতীকের কথায়, “ভাবুন, বারাণসী তো একটা ছোট শহর। এখানে এত ইলেকট্রিক বিল এলে কীভাবে খরচ চালাব? কই, আপনাদের বাংলায় তো এমনটা হয় না। ওখানকার জেলাগুলির বিলের সঙ্গে আমাদেরটা তুলনা করলেই বুঝতে পারবেন।”
নতুন রূপে সেজে উঠেছে বারাণসীর মূল আকর্ষণ কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। গঙ্গা থেকে কলসিতে জল নিয়ে বিরাট গেট দিয়ে সোজা মন্দিরের মূল দ্বারে প্রবেশ করা যায় এখন। ভিড় এড়াতে চারটে বিরাট গেট তৈরি হয়েছে। আর তার জন্য অন্তত ৪০০ পরিবারকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। উনিশের লোকসভা ভোটের আগে জানা গিয়েছিল, সেই সব পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গঙ্গার ঘাটে নীরুপমের দোকানে বসে গল্প করতে করতে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে এল। নেতা-কর্মীদের যাঁরা দাদা বলে সম্বোধন করে থাকেন, তাঁদের অনেকে প্রত্যাশিত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা সীমিত। এলাকা ছেড়ে না জুটেছে টাকা, না হয়েছে কর্মসংস্থান। বিদেশি পর্যটকদের কাছে তাই মন্দিরের নতুন বিশাল চত্বর লোভনীয় হলেও মোদির স্বপ্নের প্রকল্প হাসি ফোটাতে পারেনি বহু স্থানীয়ের মুখে। তার উপর দশাশ্বমেধ থেকে ঘাট বরাবর হাঁটলে আপাতত আর মণিকর্নিকা ঘাটে পৌঁছনো যায় না। কারণ ঠিক তার আগেই মন্দিরের মূল ফটকের নতুন সিঁড়ি তৈরি হওয়ায় বন্ধ সেই রাস্তা। অলিতে-গলিতে ‘নন্দি’রাও সেভাবে চোখে পড়ছে না। তারা ভিটে ছেড়ে শহরের বাইরে। আর জ্ঞানবাপী মসজিদ? না, সে নিয়ে আজকাল বিশেষ আলোচনা হয় না। চট করে পর্যটকরা সে পথে যাওয়ার অনুমতিও পান না।
মনে প্রশ্ন জাগে, কোন পথে বইছে গঙ্গার স্রোত? তবে কি বিপুল অর্থ খরচ করে তৈরি বাবা বিশ্বনাথের মন্দির শহরবাসীর ভাগ্য ফেরাতে ব্যর্থ? অথচ এতে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়লে ব্যবসায়ীদের আয় বাড়বে বলেই তো মনে করা হয়েছিল। বড় বড় ব্যবসায়ীরাও কি তবে পরিবর্তনের পথে হাঁটতে চাইছেন? নাহ্, তাঁদের অনেকেরই বিশ্বাস, ‘মোদি হ্যায় তো মুনকিন হ্যায়।’ মাঝবয়সি এক ব্যবসায়ী তো বলেই দিলেন, “এত বছর ধরে বারাণসীতে আছি, কোনও দিন কোনও কাজই হতে দেখিনি। কত সরকার এল, গেল, আমাদের জীবনযাত্রায় কোনও বদল ঘটেনি। তাই এখন একসঙ্গে এত কাজ হতে দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যাচ্ছে।” গঙ্গার ঘাটের পরিচ্ছন্নতা থেকে রাস্তাঘাট তৈরি, পানীয় জলের ব্যবস্থা, সবদিক থেকেই উন্নতি করেছে বারাণসী। আগের মতো এখন আর মাঝেমধ্যেই কারেন্ট চলে যায় না। আরও সহজভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে দিতে ব্যবসায়ী বলে দিলেন, “বঙ্গবাসী যেমন বুঝেছে দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বাংলার উন্নতি করেছেন, তেমন উত্তরপ্রদেশের মানুষও জানে বিজেপি সরকার অনেক কাজ করেছে।”
হরিশচন্দ্র ঘাটে ঢুঁ মেরেও একই অভিজ্ঞতা হল। বলে দিলেন, বিজেপি বিধায়ক সৌরভ শ্রীবাস্তবকে ভাল-মন্দ- সব সময়েই পাওয়া যায়। পাঁচ বছরে যোগী সরকার যা কাজ করেছে, তাতে তাদের আরও খানিকটা সময় দেওয়াই যায়। তাছাড়া বিশ্বনাথের আশীর্বাদে সব তো ঠিকই চলছে। নতুন করে আর পরীক্ষানিরীক্ষার কী প্রয়োজন।
বারাণসীর পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে নর্থ, সাউথ, ক্যান্টনমেন্ট ও রোহানিয়া বছরের পর বছর বিজেপি শাসিত। সেবাপুরি কেন্দ্র আপনা দলের দখলে। তিনদিনের সফরে বারাণসীর মন পড়ে যেটুকু বোঝা গেল, মন্দির চত্বর আর মন্দিরের বাইরে যেন একটা অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা তৈরি হয়েছে। যেখানে চাপা ক্ষোভের মাঝেই জ্বলজ্বল করছে ধর্মপ্রেম। সেই বিশ্বাসে সমাজবাদী পার্টি কিংবা মায়াবতীরা সাময়িক আঘাত হানতে পারলেও মোদির গড়ে গেরুয়া ঝড় রোখা কঠিনই হবে।
[আরও পড়ুন: মেডিক্যাল পড়া অসমাপ্ত রেখে ইউক্রেন ফেরত বাংলার পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ কী? সংসদে প্রশ্ন তুলবে TMC]
ঘাট পেরিয়ে মেন রোডে আসতেই আবার আলোচনা শোনা গেল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি অখিলেশের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে ভালই ‘খেলা হবে।’