বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: রাজ্যে বাম জমানার অবসান ঘটলেও তাহেরপুরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। জাতীয়, রাজ্য ও জেলাস্তরের ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে নিয়মিত তাহেরপুরের বামফ্রন্ট কর্মী-সমর্থকরা মানুষের নজরে থেকেছেন। আর তাই, গত বিধানসভা ভোটে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয়বার সরকার গড়ার পরেও তাহেরপুরের বাম কর্মী-সমর্থকরা বিন্দুমাত্র মনোবল হারাননি। যার প্রমাণ মিলল পুরভোটে। আর ওয়ার্ড ভিত্তিক মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ বজায় রাখাটাই নদিয়ার তাহেরপুরে (Taherpur) বামদূর্গ অটুট থাকার অন্যতম হাতিয়ার, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
রাজনৈতিক মহলের মতে, প্রায় প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে মানুষের নজরে থেকে এবারের পুরভোটে বিজেপির কাছ থেকে নিজেদের ভোটব্যাংক ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তাহেরপুরে বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকরা। জেলার অন্য পুরসভার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা গা-ছাড়া ভাব লক্ষ্য করা গেলেও তাহেরপুরের ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের সচলতাকে গুরুত্ব দিতেই হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দকেও। অথচ গত লোকসভা ভোটে বিজেপি ১৩ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২ টি ওয়ার্ডে লিড পেলেও সংগঠনকে সেই ভাবে চাঙ্গা করে রাখতে না পারায় এবারের পুরভোটে বিজেপির স্থান তৃতীয়। নির্দল প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই হলেও বিজেপি তার ধারে কাছে আসতে পারেনি। মোট ৭টি ওয়ার্ডে বিজেপি দুই অংকে রয়ে গিয়েছে। বাকি ওয়ার্ডগুলোতে তিন অংকে পৌঁছালেও জয় মেলেনি একটিতেও। বিধানসভা ভোটে তাঁরা ১২টি ওয়ার্ডে লিড ধরে রাখতে পারেনি। মাত্র চারটি ওয়ার্ডের লিড নিয়ে শান্ত থাকতে হয়েছে। যদিও সংগঠন মজবুত করে দলের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করার জন্য দলীয় নেতৃবৃন্দের তেমন কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে পাননি বলে মেনে নিচ্ছেন বিজেপির দু একজন জন সক্রিয় কর্মী।
[আরও পড়ুন: ‘ওঁর মুখে কেউ মধু দেয়নি’, দিলীপের কুকথা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ অনুব্রত মণ্ডলের]
বিধানসভা ভোটে ৯টি ওয়ার্ডের লিড তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের অনেকটাই চাঙ্গা করতে পেরেছিল। কিন্তু দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব পুরোপুরি যে কাটিয়ে ওঠা যায়নি, তা পরোক্ষে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় স্তরের তৃণমূল নেতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি মানছেন, দলীয় নির্দেশের জন্য সামনে থেকে ঐক্যবদ্ধতার রূপ দেখানো হলেও ভিতরে ভিতরে তা ছিল না। আর সেই কারণে জনসংযোগে কিছুটা ঘাটতি পরেছে। পুরভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান এবং প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল কিন্তু সেই বামফ্রন্টই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাহেরপুর এলাকায় ১৯৯৩ সালে তৈরি হয়েছিল মনোনীত বোর্ড। এখানে প্রথম পুর নির্বাচন হয় ১৯৯৫ সালে। প্রথমবারের ভোটে জিতে যায় বামফ্রন্ট। আসলে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত তাহেরপুরে উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার সময় প্রথম সারিতে ছিলেন সেই বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকরাই। তারাই উদ্বাস্তু আন্দোলনটিকে সংগঠিত করেছিলেন। পরে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বেশ কয়েকজন উদ্বাস্তু মানুষকে জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছিল। আর সেই কারণেই এখানকার একটা বড় অংশের মানুষ লাল পতাকার দিকেই আগাগোড়া ঝুঁকে থেকেছেন। বামপন্থীদের প্রতি তাঁদের একটা অন্যরকম দুর্বলতা রয়েছে। যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের মোদি-ম্যাজিক কাজে লাগে তাদের মনেও। বামফ্রন্টের একটা বড় অংশের ভোট চলে যায় বিজেপির বাক্সে। বিধানসভা ভোটে কিন্তু বামপন্থীরা সেই ভোট নিজেদের দিকে ফেরাতে পারেননি। কিন্তু বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকরা আন্দোলন থেকে এক পা-ও সরে যাননি। এবারের পুরভোটে মানুষকে আবার সেই লাল পতাকার দিকে ফেরাতে তাঁরা সফল হয়েছেন। অথচ পুরভোটে পট পরিবর্তন কিন্তু এর আগেও হয়েছিল।
১৯৯৭ সালে বামফ্রন্টের দু’জন কমিশনার যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেসে। প্রায় আড়াই বছরের জন্য পুরবোর্ড পরিচালনা করেছিল কংগ্রেস। যদিও ২০০০ সালে বামফ্রন্ট ফের ক্ষমতায় আসার পর ১০ বছর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১০ সালে রাজ্যে যখন পালাবদলের হাওয়া বইছে, তখন তাহেরপুরের নিরঞ্জন মিস্ত্রি-সহ কয়েকজন নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। নিরঞ্জন পরে জয়লাভ করার পর তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে বোর্ড গঠন করে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। পরে ২০১৫ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরে বামফ্রন্ট। এরপর টানা চলতে থাকে তাহেরপুরে বাম শাসন। এবারের পুরভোটে ঘটেনি তার ব্যাতিক্রম। কেন্দ্র এবং রাজ্যের জনবিরোধী যেকোনও ইস্যুকে সামনে এনে পথসভা ও মিছিল, ছোটখাটো বৈঠকের মাধ্যমে সিপিএমের যুব সংগঠন, ছাত্র সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে জনসংযোগ ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। শুক্রবার সন্ধ্যায় সিপিএমের তাহেরপুর এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুপ্রতিপ রায় জানিয়েছেন, “চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান কে হবেন, তা নিয়ে এখনও চর্চা শুরু হয়নি। আমরা এখন বর্তমানে আমাদের আহত কমরেডদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো এখন আমাদের প্রধান কাজ। চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান কে হবেন, সেটা পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবে।”