বিয়েবাড়ি মানেই খানাপিনায় কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি। কবজি ডুবিয়ে চলে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। মনকাড়া সব ভাজাভুজি, মিষ্টির সুবাসে প্রাণ উচাটন হয়ে না-উঠলে আর কীসের বিয়েবাড়ি! যদিও এখনকার বুফে বা ক্যাটারিং-এর জমানায় ভিয়েন বসানো বিয়েবাড়ির ছবি কল্পনা করা কঠিন। আর সময়ের সঙ্গেই সঙ্গেই মিলিয়ে গিয়েছে পুরনো সেই দিনের খাবার।
তবে, ফিরে দেখলে মন্দ হয় না। কেমন ছিল সেকালের খানাপিনা?
বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিবর্গ, পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই হাজির সানন্দে। বিয়ে, পাকাদেখার আগে থেকেই মেয়েমহলে তোড়জোড় চলত নাড়ু পাকানোর, ফর্দ বানানোর। পাকাদেখার আগে ছিল কাঁচাদেখা অর্থাৎ দু’বাড়ির অভিভাবক, ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়ে পাকা কথা দেওয়া-নেওয়া হবে হুঁকো বিনিময় করে। কলাপাতার নল দিয়ে রূপো বাঁধানো হুঁকো ছিল এ আসরের আকর্ষণ। এরপর আনন্দনাড়ু দিয়ে এই খুশির খবর জানানো হবে বাকি লোকজনকে।
এরপর আসত বিয়ের ভোজের সমারোহ। অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে ছিল বাবুদের প্রতিপত্তি দেখানোর এক সুবর্ণসুযোগ। তাই তাক লাগানো সব খাবারের আয়োজন করা হত। শরৎকুমারী চৌধুরাণীর লেখা থেকে এই ভোজের একটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে— ‘রান্না হইয়াছে পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রোহিতের মুড়া দিয়া মুগের ডাল, আলুর দম, মাছের চপ, ছক্কা, চিংড়ির কাটলেট, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা, পটোল ভাজা, দই মাছ, চাটনি; তারপর লুচি, কচুরি, পাঁপড় ভাজা; একখানি সরাতে খাজা, গজা, নিমকি, রাধা বল্লভি, শিঙাড়া, দরবেশ, মেঠাই; একখানা ঝুড়িতে আম, কামরাঙা, তালশাঁস ও বরফি সন্দেশ; আর একখানায় ক্ষীরের লাড্ডু, গুজিয়া, গোলাপজাম ও পেরাকী। ইহার উপর ক্ষীর, দধি, রাবড়ি ও ছানার পায়েস। বাবুদের জন্য মাংসের কোর্মা ছিল, কিন্তু মেয়েরা অনেকেই মাংস খান না, এ জন্য তাহা মেয়েদের মধ্যে পরিবেশন করা হইল না।’
এ তো গেল বড়লোকদের বিয়ের ভোজের মেনু; সাধারণ গেরস্ত বাড়ির ভোজের পদে থাকত শুক্তো, দুই এক রকমের ডাল, দু’তিন রকম ভাজা, শাকের ঘণ্ট, মোচার ঘণ্ট, ছ্যাঁচড়া, মাছের ঝোল, অম্বল, পায়েস, কলার বড়া ইত্যাদি। অনুষ্ঠানের ক'দিন আগে থেকে বসত ভিয়েন। পান্তুয়া, জিবেগজা, চিত্রকূট, প্যারকি, সন্দেশ, বোঁদে নিমকি, লবঙ্গলতিকা ইত্যাদি নানা ধরনের মিষ্টি তৈরি করতেন হালুইকরেরা। এখনকার বিরিয়ানি, কাবাব, আইসক্রিমকে গোলে গোলে হারিয়ে দিতে পারত সেকালের বিয়েবাড়ির ভোজ। এক কথায় বলা যায়, বিয়েবাড়ি এক একটি অঞ্চলের খাদ্য-সংস্কৃতিরও সাক্ষ্য বহন করে।
(প্রতিবেদনটি 'ছাঁদনাতলা' ফিচারের অংশ।)