সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: আশ্বিনের শারদপ্রাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনির্বচনীয় কণ্ঠস্বর রেডিওতে বেজে উঠলেই বাঙালির জীবনে সূচিত হয় মহালয়া (Mahalaya)। বাঙালির কাছে এই মহালয়া অন্যতর তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, মহালয়া তিথিটির মাহাত্ম্য। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনালগ্নটি মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত। এই সন্ধিক্ষণ মানব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়া অর্থাৎ মহান যে আলয়, এই কথাটির ব্যাখ্যা নানা ভাবে করেছেন প্রাজ্ঞজনেরা। যেহেতু মহালয়া থেকেই দেবী দূর্গার আবাহন মুহূর্তটি চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই অনেকের মতে দেবী স্বয়ং হলেন এই আলয় বা আশ্রয়। ভিন্নমতে, এই মহান আলয় হল পিতৃলোক। যেহেতু এটি পিতৃপক্ষের অবসান চিহ্নিত করে। ঠিক এর পরদিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা।
পিতৃপক্ষের এক পক্ষকাল পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসে। পুরাণমতে, ব্রহ্মার নির্দেশেই গড়ে ওঠে এই মহামিলনক্ষেত্রটি। এই সময় তাই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে মানুষ। শাস্ত্রমতে, হিন্দুদের অবশ্য পালনীয় যে পঞ্চমহাযজ্ঞের বিধান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল পিতৃযজ্ঞ অর্থাৎ তর্পণাদি। এই তর্পণ কথার অর্থ হল, যাতে অন্যের তৃপ্তি হয় সেই উদ্দেশ্যে জলদান। তর্পণ তাই শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই নয়, সর্বভূতের উদ্দেশেই করতে হয়। তর্পণের মন্ত্রের ভিতরই নিহিত রয়েছে সেই নির্দেশ-
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং দেবর্ষিপিতৃমানবাঃ।
তৃপ্যন্ত পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহোদয়ঃ।।
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু।
[আরও : নারীকণ্ঠে চণ্ডীপাঠ কি আদৌ আপত্তিকর? কী বলছে সনাতন হিন্দু শাস্ত্র]
অর্থাৎ, দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, নরগণ - ব্রহ্মা হইতে তৃণশিখা পর্যন্ত সমস্ত জগৎ আমা কর্তৃক প্রদত্ত অন্নজলে তৃপ্তিলাভ করুন। এই হল তর্পণের গূঢ় কথা। শাস্ত্র বলে, সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম- অর্থাৎ, সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়। তাই জলদান করতে হয় সর্বভূতের উদ্দেশ্যেই। যেহেতু পিতৃপক্ষে পিতৃলোক ও মনুষ্যলোক কাছাকাছি চলে আসে, তাই ধারণা করা হয়, এই সময়কালে যদি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ অর্থাৎ জলদান করা হয়, তবে তা তাঁদের কাছে সহজে পৌঁছায়। যার মহাপ্রকাশ পিতৃপক্ষের শেষ দিনটিতে অর্থাৎ মহালয়ায়। এই কারণেই পিতৃপক্ষের অবসানে মানুষ তর্পণে রত হন। মহালয়ার এক অর্থ যে পিতৃলোক, তা এই ধারণা থেকেই উঠে এসেছে। একই সঙ্গে পিতৃপক্ষের অবসানে, দেবীপক্ষের সূচনাও যেহেতু চিহ্নিত হয়, তাই মহালয়া অর্থে মা দুর্গাকেই আশ্রয় ধরা হয়। শাস্ত্রে কথিত আছে, এই দিনেই মহিষাসুর বধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেবী দুর্গা। মহিষাসুরের কবল থেকে দেবগণকে উদ্ধার করার লগ্ন যেহেতু এখান থেকেই সূচিত হচ্ছে, তাই পরমা প্রকৃতি বিশ্বজননীর আশ্রয়ই হল মহান আলয়, এমত মত পোষণ করেন অনেকে।
মহালয়া শুভ না অশুভ, এ নিয়েও তর্ক কম নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই দিনটি শুভ নয়। যেহেতু এইদিন পিতৃপুরুষের স্মরণ করা হয়, তাই প্রকৃতপক্ষে এ আসলে শোকের দিন। দিনটিকে সেহেতু শুভ বলে চিহ্নিত করা সঙ্গত নয়। মতান্তরে, হিন্দু শাস্ত্রে যে কোনও শুভ কাজের সূচনাতেই পিতৃপুরুষকে স্মরণ বা তর্পণ করা হয়। যে রীতি হিন্দুর নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্তর্গত, তাকে অশুভ বলাও বাঞ্ছনীয় নয়। যদি তর্পণের বৃহত্তর অর্থটি ধরতে হয়, তা আসলে ইঙ্গিত দেয় জগৎব্যাপী এক মহামিলনক্ষেত্রের। মিলনের এই মুহূর্ত এবং তার উৎযাপন তাই কোনোভাবেই অশুভ হতে পারে না।
বাঙালির কাছে অবশ্য পিতৃপক্ষের এই শেষ দিনটি আলাদা তাৎপর্য বহন করে। দেবীপক্ষের সূচনা চিহ্নিত হওয়া মানেই বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপুজো (Durga Puja 2021) এসে পড়া। সেই সুরটি বাঁধা হয়ে যায় রেডিওতে 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারে। গড় বাঙালির কাছে তা মহালয়া নামেই পরিচিত। ১৯৩২ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচার শুরু হয় আকাশবাণী থেকে। স্বনামধন্য বহু মানুষ বিভিন্ন সময় চণ্ডীপাঠ ও সঙ্গীতায়োজনের দায়িত্ব পালন করেন। পিতৃপক্ষের অবসানের ভোরে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে কালক্রমে। বর্তমানে আমরা 'মহিষাসুরমর্দিনী'র যে রূপটি শুনতে পাই, তা ১৯৬৬ সালে রেকর্ড করা। যেখানে বাণীকুমারের গ্রন্থনায় চণ্ডীপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra)। বাঙালির কাছে এই অনুষ্ঠানটি ছাড়া মহালয়া যেন সম্পূর্ণতা পায় না।
মহালয়া নিয়ে নানা ব্যাখ্যা, নানা মত রয়েছে। শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্ব বা তর্কও ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে। তবে, মহালয়ার ভিতর যে মহামিলনের ইঙ্গিত তা বৃহত্তর সম্প্রীতি আর মেলবন্ধনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তর্পণের মধ্য দিয়েও সর্বভূতের সঙ্গে মানবের একাত্মতার তত্ত্বটিই প্রকাশিত। এই তাৎপর্যয়ই মহালয়াকে গরিমা দান করেছে।