shono
Advertisement

Breaking News

নতুন মোড়কে পুরনো প্রশাসন, পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই!

নতুন সেনাপ্রধানের নিযুক্তির তাৎপর্য কী? ভারতের কাছে এই নিয়োগের অর্থ কী?
Posted: 09:28 PM Dec 10, 2022Updated: 09:28 PM Dec 10, 2022

পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই। ৭৫ বছর ধরে সেই একই পাশা খেলা। নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির আসার পর পাকিস্তান কি সংস্কারবাদী পথে হাঁটবে, না কি এখনও ৭৫ বছরের সেই পুরনো সামরিক মুসলমানতন্ত্র রেসিপি মেনেই আরও পশ্চাদমুখী হবে? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

-সপ্তাহে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করব, পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে নিয়ে। জেনারেল কামার বাজওয়া-র পর এই নতুন সেনাপ্রধানের নিযুক্তির তাৎপর্য কী? ভারতের কাছে এই নিয়োগের অর্থ কী?

এই মুখ‌্য আলোচনার আগে আসুন, ইরান এবং সৌদি আরবের দুটো পুরনো গল্প শোনাই আপনাদের। গল্প বটে, তবে সত‌্য ঘটনা অবলম্বনে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ইরান গিয়েছি। ইনকিলাব স্ট্রিটে সারি-সারি বইয়ের দোকান। ঠিক আমাদের কলেজ স্ট্রিটের মতো। সঙ্গী দোভাষী ইরানি, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক যুবতী বলেছিলেন, ১৯৭৯-তে ইরানের শাহ-কে ক্ষমতাচ্যুত করার বিদ্রোহ দেখে ইরান ভেবেছিল- আমরা আধুনিক, আমরা স্বাধীন। শাহের প্রাসাদে রাখা ভিক্টোরিয়ান তৈলচিত্র, সাহেবি লম্বা-লম্বা ডাইনিং টেবিল, পোর্সিলিনের ডিনার সেট, পেয়ালা-পিরিচ দেখাতে-দেখাতে সেই মেয়েটি বলে উঠল, ’৭৯ আমাদের এই পাশ্চাত‌্য আধুনিকতাকে লাথি মারতে শেখাল। তার বদলে আমরা পেলাম আয়াতোল্লা খোমেইনিকে। সামন্ততান্ত্রিক ইসলামের নাম-ভাঙানো মৌলবাদের পুনর্নবীকরণ। দুর্ভাগ‌্য আমাদের আধুনিক প্রজন্মের।

[আরও পড়ুন: ‘মানবিক সাহায্যে’র ফায়দা তুলছে জঙ্গিরা! নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার প্রস্তাবে ভোট দিল না ভারত]

দ্বিতীয় গল্পটি সৌদি আরবের। রিয়াধ শহরের এক সন্ধ‌্যা। সরকার জানাল, সৌদির শিক্ষামন্ত্রী প্রেস ক্লাবে ভারতীয় প্রতিনিধি সাংবাদিকদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খেজুর, কিশমিশ, আর নানা ধরনের মাংস পরিবেশন করে শিক্ষামন্ত্রী বললেন, তেল অনেক হয়ে গিয়েছে। আমাদের বাজেট উদ্বৃত্ত। এখন আমাদের দরকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। আমেরিকা আমাদের তেল কিনে যাচ্ছে, আপনারা প্রত্যেকে কিনছেন। আমেরিকা তেল জমাচ্ছে। আমাদের তেল তো একদিন ফুরোবেই, কিন্তু মেধা কোথায়? আমাদের নিজেদের ইঞ্জিনিয়র-ডাক্তার, বিজ্ঞানী, তথ‌্য-প্রযুক্তিবিদ প্রয়োজন। তা না হলে, আমাদের ভবিষ‌্যৎ অন্ধকার।
সত্যি কথা বলছি, এই নৈশভোজে যাওয়ার আগে আমরা নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছিলাম- সৌদি-র আবার শিক্ষামন্ত্রী? গরুর গাড়ির আবার হেডলাইট? কিন্তু হার্ভার্ড-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষামন্ত্রী যখন বললেন, কেন তাঁরা ভারতের আইআইটি সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন, ভারতীয় শিক্ষকদের সে-দেশে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে চাইছেন, তখনই বুঝলাম, তারা মৌলবাদের পথে নয়, প্রগতির রাস্তায় হাঁটতে চায়। রসিকতা অন‌্যায়।

এবার ’৭৯ সালের তিনটি বড় ঘটনা। প্রথম ঘটনা, ইরানে খোমেইনির নেতৃত্বে মৌলবাদের উত্থান। দ্বিতীয়, সৌদিতে শিয়া-অসহিষ্ণু মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত স্থানীয় মক্কা। অভিযোগ, আমেরিকার হাতে তামাক খেতে গিয়ে আরবে ইসলাম বিপন্ন। তৃতীয় ঘটনা, আফগানিস্তানে রুশ সেনা অভিযান, ’৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পাকিস্তান ও আরবের বিরোধিতা।

এখন প্রশ্ন, নয়া পাক সেনাপ্রধানের অভিষেকের কথা বলতে শিবের গীত কেন? কারণ, মুসলিম দুনিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তালিবান আছে সেই তিমিরেই। তারা এত যুগ পরেও সামন্ততান্ত্রিক, পশ্চাদমুখী মৌলবাদী ইসলামের অপব‌্যবহারকারীদের হাতের পুতুল।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর স্বৈরতন্ত্রী আইয়ুব খানের পতন হল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো আঘা মহম্মদ ইয়াহিয়া খান-কে সরিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হয়ে ক্ষমতায় এলেন। সেই ’৭১ সালের শেষে ভুট্টোর ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের ঘটনা ইমরান খানকে আবার একবার সতর্ক করছে। ভুট্টোর ফাঁসি এবং সামরিক ‘কু’ ইয়াহিয়া-র ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করে। মুশারফ নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সেনা অভ্যুত্থানের মধ‌্য দিয়ে। মুশারফের পর আবার গণতন্ত্রর নতুন সনদনামা ঘোষিত হয়। সেসব দলই আবার এখন পাকিস্তানে ক্ষমতায়। এখন নাম পিডিএম (পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট)।

ইমরান তাঁর শাসনে সেনা-নিয়ন্ত্রণমুক্ত পাক গণতন্ত্রর স্বাদ কেমন, তা মানুষকে জানাতে পারলেন না। কারণ, তিনিও ক্ষমতাচ্যুত হলেন। জেনারেল বাজওয়া পদত‌্যাগের আগে ঘোষণা করে গেলেন, আমরা এক ‘নর্মাল’ পাকিস্তান গড়ার অভিমুখে চলেছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক চাই। বাজওয়া বলেছেন, ৭০ বছরের টালমাটাল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে পাক সেনা এবার হবে ‘অরাজনৈতিক’ সেনা।

সত্যি কত্তা! ঘোড়ায় হাসবে না তো? ১৯৮০ সালে মহম্মদ জিয়াউল হক মিলিটারি জোট গঠন করে ধর্মীয় দলগুলিকে জাপটে ধরে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বর বৈধতা অর্জন করে। সেনা সাধারণ মানুষের মতামত অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব করছে- এই বার্তা দিতে আইএসপিআর (ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস) নামক মিডিয়া মেশিনারিকে ব‌্যবহার করে, পাক সেনার আধুনিক ব্র্যান্ডিংয়ের জন‌্য।

বাজওয়া-কে নিযুক্ত করেন নওয়াজ শরিফ। ২০১৭ সালে সেই নির্বাচিত সরকারের প্রধান নওয়াজ-ই বিতাড়িত হলেন। ২০১৮ সালে ইমরানকে বসিয়ে পাক সেনা আবার পাক ইতিহাসে আর একটি ‘হাইব্রিড’ সরকার গঠন করল। তবে বাজওয়া তাঁর ক্ষমতার শেষভাগে ভোল পালটে ইতিবাচক, আধুনিক বার্তা দিলেন। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। ভারতের সঙ্গে সেনা-সংঘর্ষ বিরতি ঘোষণা করেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগের প্রত‌্যক্ষ সেতু গড়ে তোলেন। ভারতের সঙ্গে আলোচনা চান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে দৌত‌্য ও অর্থসাহায‌্য চান, প্রতিরক্ষা সাহায‌্য চান। চিনের সঙ্গে সাবেক অক্ষ থাকলেও, আমেরিকার সঙ্গেও ভুল বোঝাবুঝির অবসান চান।

ইমরান প্রধানমন্ত্রী হয়ে যে আইএসআই প্রধানকে তাড়িয়ে দেন, যাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিষময় হয়ে ওঠে, সেই বাজওয়া-ঘনিষ্ঠ আসিম মুনির সেনাপ্রধান হওয়ায় প্রথমেই প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে পাক সেনা ‘অরাজনৈতিক’ হবে কী করে? নওয়াজ শরিফ স্বেচ্ছা নির্বাসন ত‌্যাগ করে সেনা সমর্থনে দেশে ফিরবেন এবার? পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন পদ ‘সেনাপ্রধান’ আজকের নতুন ‘হাইব্রিড’ পার্সনের মুখ হিসাবে এবার কাকে বাছবে? ২০১৭ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান বিতাড়িত হয়ে ২০১৮ সালে নতুন সেনা-সমর্থিত ‘হাইব্রিড’ সরকার? ইতিমধ্যে ইমরান সেনাবিরোধী প্রচার চালিয়ে দুনিয়ার সামনে পাকিস্তানের সেনার বিশ্বাসযোগ‌্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

মুনিরের সামনে তাই মস্ত বড় চ‌্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের নর্দার্ন এরিয়ার কমান্ডার হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। গুজরানওয়ালার ‘কোর কমান্ডার’ হিসাবেও তিনি কাজ করেন অতীতে। এই দু’ক্ষেত্রেই ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তাঁকে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়েছিল। গত আড়াই বছর ধরে তিনি বাজওয়ার নীতি মেনেই কাজ করেছেন। এদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থাও শোচনীয়। তাই ভারত আশা করছে, বাজওয়া-র ডকট্রিনে মুনিরও হয়তো কোনও আমূল বদল আনবেন না। তবু পাকিস্তান পাকিস্তানেই। ৭৫ বছর ধরে সেই একই পাশা খেলা। যেমন, আফগানিস্তানে নতুন তালিবান সরকার গঠনের পর অবস্থা আরও খারাপ। পাক-আফগান সীমান্ত বিরোধও মিটল না। পাক সেনা ক্ষুব্ধ। দু’-সপ্তাহ আগে কাবুলে ১৪ জনকে ইসলামিক প্রাচীন আইন মেনে চাবুক মেরে হত‌্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে তিনজন মহিলা। সরকারের বার্তা একটাই, মধ‌্যযুগীয় আইন মানতে হবে, মেয়েরা স্কুলে যাবে না। যদিও কাবুলের একটা অংশ রাষ্ট্র সংঘ ও আধুনিক দুনিয়ার সমর্থন আদায় করতে বলছে, মেয়েদের শিক্ষা প্রয়োজন। এসবই স্ববিরোধ!

ইরান আর সৌদির গল্প থেকে শুরু করেছিলাম। ইরানে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। সরকার সামলাতে পারছে না। সেপ্টেম্বরে ইরানে ধর্মীয় পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনি নামে এক যুবতীর মৃত্যু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ঠিকমতো হিজাব পরেননি বলে। তিনমাস হয়ে গেল। এখনও আন্দোলন সামলানো যাচ্ছে না। জনসমর্থন বাড়ছে। আন্দোলনের চাপে হিজাব নীতি রদ হওয়ার পথে অবশেষে। বিশ্বকাপের শুরুর খেলায় ইরানের ফুটবল টিম জাতীয় সংগীত গাইতে রাজি হয়নি এই ঘটনায় সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদে। ভাবুন একবার!

’৭৯ সালের উল্টো হাওয়া বইছে সে-দেশে। সৌদিতে তো ক্ষমতার শীর্ষ থেকেই সংস্কারের ডাক, বিদ্রোহর চেষ্টা হচ্ছে, যারা ক্ষমতায় নেই, সেই উল্টো দিক থেকে। কিন্তু তারা এখনও দুর্বল। ২০১৫ সালে মহম্মদ বিন সলমন যুবরাজ হিসাবে দায়িত্ব পেয়েই সংস্কারের পথে হাঁটেন। মুসলমানদের সামাজিক জীবন থেকে গুরুত্ব কমিয়েছেন। আর্থিক সংস্কার করে তেলের উপর রাজতন্ত্রর নির্ভরশীলতা কমিয়েছেন। গতিশীল আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে তেলের ব‌্যবসাকে যুক্ত করতে চাইছে সরকার। তিনি মেয়েদের স্বাধীনতা বাড়িয়েছেন। এসব ইসলামিক রাষ্ট্রেই তো হচ্ছে! ১৯৭৯ সালের উল্টো হাওয়া।

তাহলে পাকিস্তান কোন পথে হাঁটবে? সৌদি-ইরান-সংযুক্ত আমিরশাহীর পশ্চিমি দুনিয়ার সংস্কারবাদী পথে হাঁটবে, না কি এখনও ৭৫ বছরের সেই পুরনো সামরিক মুসলমানতন্ত্র রেসিপি মেনেই আরও পশ্চাদমুখী হবে? নরেন্দ্র মোদি আপাতত চুপ। তিনি দেখছেন। দেখতে চাইছেন, মুনির-শরিফ হাইব্রিড প্রশাসন কী করে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com

[আরও পড়ুন: প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’, নিন্দার মুখে পালটা তালিবানের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement