সরোজ দরবার: পাইলট প্রজেক্ট! এই ক’দিন আগেও যদি কেউ এ কথার মানে না জেনে থাকেন, তবে এখন নিশ্চিতই জানেন। সৌজন্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী। উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের প্রত্যর্পণের খবর পেয়ে পানিং মিশ্রিত তাঁর তির্যক প্রয়োগের জেরে এখন গোটা দেশে ‘পাইলট প্রজেক্ট’ তুমুল জনপ্রিয়। যেমনটি প্রধানমন্ত্রীর আর পাঁচটি কথার ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় এবার অন্য নানা অনুষঙ্গে কথাটির ব্যবহার হবে। বিভিন্ন সার্চিং সাইটেও জোর কদমে সন্ধান চলছে পাইলট প্রজেক্টের অর্থের।
[যুদ্ধের হাত ধরে শান্তি অসম্ভব]
এই সন্ধানের বাইরে সম্ভবত আরও একটি পাইলট প্রজেক্টও চলছে। একটু ধীরে, কিন্তু স্থির বিশ্বাসেই। সে খোঁজ অবশ্য আজকের নয়। সে খোঁজ মানুষের দেশের। যে দেশ গণ্ডিবদ্ধ দেশের ধারণাকেই একমাত্র দেশ বলে মনে করে না। বরং মনে করে একটা অন্য পৃথিবী আছে, যেখানে কেউ ভারতীয়, পাকিস্তানি বা ইজরায়েলি নয়। যেখানে সমস্ত গুলির পরিণতিই এক, সমস্ত খিদের অনুভূতিই সমান, সকল বিপর্যয়ই সমান অসহায়ত্ব নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু এমন ভাবাবেগে আপ্লুত চিন্তাভাবনা কি কোনও কাজের কথা? এই নিরুপদ্রব চেয়ারে বসে এসব বড়বড় কথা লেখা যায়। কিন্তু যখন গুলি চলে, যখন সন্ত্রাস মুখে কালো কাপড় বেঁধে এসে আমাদেরই মারতে থাকে, তখন কি মানুষের দেশের শৌখিন ধারণা আমাদের এসে রক্ষা করে, না করবে? এ প্রশ্ন সঙ্গত। এবং তার রেডিমেড উত্তর এই যে, যদি এককালে কেউ সহনশীলতার পরিচয় দিয়েও থাকে, এখন আর তা করবে না। চোখের বদলে চোখ নয়, এমন দার্শনিক ভাবনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেচারি চোখ বাঁচে না। ফলে চাই নতুন দেশ, যে ঘরে ঢুকবে এবং মারবেও। মনে করুন, জনপ্রিয় ‘উরি’ সিনেমার সংলাপটিকে। তরুণদের একাংশের কাছে যা এখন প্রায় বেদবাক্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সন্ত্রাসের নিরিখে নয়, অন্যান্য বহু ক্ষেত্রেও। ধরে নেওয়া হচ্ছে, এটাই প্রজন্মের অ্যাটিটিউড।
ঠিক এই বিন্দু থেকেই এবার পিছিয়ে গিয়ে সেই রাত্রিটিকে আমরা মনে করি, যখন শত্রুশিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর ঘুমন্ত পাঁচ পুত্রের মুণ্ডচ্ছেদ করছে অশ্বত্থামা। প্যাঁচা যেমন ঘুমন্ত কাকের বাসায় আক্রমণ হেনেছিল, সেই একই কায়দায়। সেটাই হয়তো ছিল আদি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এও নিঃসন্দেহে রণকৌশল। অস্বীকারের জায়গা নেই। শত্রুশিবিরে এভাবে ঢুকতে সাহস প্রয়োজন, শত্রুবধে বীরত্বও জরুরি। অশ্বত্থামার বাবাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার বদলা নিতেই তো ছিল এই পরিকল্পিত আক্রমণ। সুতরাং একটা জিনিস স্পষ্ট যে, এ কোনও নতুন ভারতের কথা হচ্ছে না। বরং এটাই নতুন ভারতের বেদ-গীতা বলে জোর করে যা প্রচারিত হচ্ছে, তা ভারতবর্ষ বহু আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে বা তা থেকে উত্তরণের রাস্তা খুঁজেছে। কারণ, এই হটকারী আক্রমণের পর যে মারাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেই ব্রহ্মশির অস্ত্রের ঠোকাঠুকিতে প্রাণ গিয়েছিল অভিমন্যুর পুত্রের, সে বেচারি তখনও জন্মায়ইনি। মাতৃগর্ভেই তার মৃত্যু হল। ফলে ইঙ্গিত তো স্পষ্ট। একটা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, তার পরবর্তী যুদ্ধ এবং অনাগত প্রজন্মের বিনষ্টি। সেদিন কৃষ্ণ বাঁচিয়েছিলেন মৃত শিশুটিকে।
শোনা যায়, অশ্বত্থামার নাকি মরণ নেই। তাই সে আজও যখন তখন এর ওর ঘাড়ে চেপে বসে সম্ভবত। বাসে-ট্রামে, চা-দোকানে ডিম টোস্ট খেতে খেতে তাই লোকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চায়। সেনার প্রয়োজন ভিন্ন। দেশের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমনে যা প্রয়োজন তা সেনা করেছে। এবং সেই সিদ্ধান্তের পিছনে যে বহু পরিণত মস্তিষ্ক কাজ করে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেনার সাফল্যের রাজনীতিকরণ আর হিন্দি সিনেমার দৌলতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়ে দাঁড়াল যেন লুকিয়ে আম পাড়ার মতো বিষয়। ফলে সকলেই তা চাইছেন। যুদ্ধকামনা যেন গণ-হিস্টিরিয়া। কারণ উত্তরার সন্তানের মৃত্যু তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যে আনছেন না। বরং ভাবছেন উলটোটা। কিন্তু কোনও যুদ্ধ, কোনও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকই যে শেষমেশ ভ্রূণকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, এটাই ভবিতব্য। পুলওয়ামার ঘটনার পর যেভাবে বৃহত্তর অংশ যুদ্ধার্থী হয়ে পড়ল, তাতে আশংকা যে অদূর ভবিষ্যতে বহু উত্তরার গর্ভই বিনষ্ট হবে। দুর্ভাগ্য যে এবার আর কোনও কৃষ্ণ থাকবেন না, মৃত শিশুকে পুনর্জীবিত করতে।
এ সবের মধ্যেই তবু মনে হয়, চলছে এক পাইলট প্রজেক্ট। তা ওই মানুষের দেশের। আজ সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় গোটা বিশ্বের কোনও কিছুই আর অপ্রকাশ্য নয়। সারা পৃথিবীতে কারা সন্ত্রাসের ফেরিওয়ালা আর যুদ্ধ হলে কাদের চোয়াল ভাঙছে, পাঁজরা ফুটো হচ্ছে তা সকলেই জানেন। হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া আছে বলেই তা একটু বেশিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং এই মাধ্যম ব্যবহারকারী তরুণ প্রজন্মের মনও বদলে দিচ্ছে অনেকাংশে। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই- এ তো নতুন কথা নয়। কিন্তু যেভাবে তরুণ প্রজন্ম অরাজনৈতিকভাবে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন, সেটাই সদর্থক। ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে বন্দি করার পর পাকিস্তানেরই একটা অংশ যেভাবে তার প্রতিবাদ করেছে, তাকে তো সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। প্রশাসন, রাজনীতি, কূটনীতির কথা হচ্ছে না। বলছি, সেই সব অগণিত ফেসবুক, টুইটার ব্যবহারকারীর কথা যারা একযোগে কামনা করেছেন অভিনন্দন সুস্থভাবে স্বদেশে ফিরুন। তাঁরা পাকিস্তানের অধিবাসী হতে পারেন, কিন্তু তাঁরা যুদ্ধ চান না। সেই সাধারণ নাগরিকদের কথা আবার দায়িত্ব নিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য ভারতবাসী। অভিনন্দনের মুক্তির দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীর ছবি ভাগ করে নিয়েছেন ভারতীয় তরুণ আর লিখছেন, একজন ভারতীয় হিসেবে তিনিও যুদ্ধ চান না। প্রোফাইল পিকচারে তুলে এনেছেন সেই বৃদ্ধকে, যিনি উইং কমান্ডারের মুক্তি প্রার্থনা করছেন। এখন, ভারচুয়াল মিডিয়ার এই কার্যকলাপে কিছু কি বদলায়? হয়তো তেমন কিছুই নয়। কারণ এ সব কিছুরও রাজনীতিকরণ হবে, আবার হিরো হিরো মার্কা সিনেমা করে যুদ্ধের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে দেওয়া হবে। দুর্ভাগা সে দেশ যেখানে বীরের প্রয়োজন হয়, আরও দুর্ভাগা সে দেশ যেখানে বীরত্বকে ব্যবসায় নামিয়ে আনা হয়। তবু এসবই হবে, হতে থাকবে ক্রমাগত। শোনা যাচ্ছে, পুলওয়ামা নাকি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-২, নতুন সিনেমার নাম কী হবে, তা নিয়ে প্রযোজকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়েছে। অর্থাৎ ভারচুয়াল মিডিয়ার এই ভাগাভাগি হয়তো বিশেষ কাজে লাগবে না। তবু তা স্পষ্ট জানান দেয় এক ইঙ্গিত, এক যুগলক্ষণের। বুঝিয়ে দেয়, একটা দেশ তৈরি হচ্ছে যা ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, ইজরায়েলের মধ্যে থেকেও আলাদা। সে দেশ কেবলই মানুষের। অল্প হলেও তরুণের একাংশ এখন জানে, ব্রহ্মশির অস্ত্রে ঠোকাঠুকি হলে ফল কী হয়! কার উপর এসে কোপ পড়ে। ভেজা ছাতা গোটাতে গোটাতে কোনও প্রৌঢ় তাই যখন বলেন, ‘এখুনি অ্যাটাক করতে লাগে’, এই তরুণ প্রজন্ম আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে তাই কানে হেডফোন দেয়। কেননা তারা জানে, তারা শুধু যুদ্ধ প্রত্যাখ্যানই করছে না, সোচ্চারে তা বলছেও। তারা জানে, এতে দেশদ্রোহী তকমা পেলেও, গোটা পৃথিবীতে যে আলাদা একটা দেশের জন্ম হচ্ছে সেখানে তাঁদের জায়গা হবে। এবং তাঁদের বিশ্বাস একদিন পৃথিবীতে একটাই দেশ থাকবে, তা শুধু মানুষের। যে দেশের অভিধানে আর যুদ্ধ কথাটা ফলাও করে রাখার প্রয়োজন পড়বে না।
তবে এখনও এ স্বপ্নের বহর-বিস্তার অল্প। ওই যে ‘পাইলট প্রজেক্ট’। তবে কে না জানে, যে কোনও পাইলট প্রজেক্টই একদিন বাস্তবে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা ধরে রাখে! সে সম্ভাবনা সত্যি করার দায়িত্ব কি আমাদেরও নয়!
হাউ ইজ দ্য জোশ, মানুষ?
The post মানুষের দেশ, অন্য এক ‘পাইলট প্রজেক্ট’! appeared first on Sangbad Pratidin.