বাবুল হক ও শাহজাদ হোসেন, মালদহ ও ফরাক্কা: ওড়িশার সম্বলপুরে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশি সন্দেহে খুন হয়েছে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক জুয়েল রানা। তাঁর সহকর্মীরাও একই সন্দেহে নির্যাতনের শিকার হন। গুরুতর জখম হয়ে মুর্শিদাবাদের সুতির মধুপুরের বাসিন্দা সানোয়ার হোসেন ও মালদহের আখেনুর শেখ সম্বলপুর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওড়িশা ছেড়ে ফিরলেন নিজেদের বাড়িতে। ভয়াবহ সেসব অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে শিউড়ে উঠছেন মুর্শিদাবাদের সানোয়ার হোসেন, মালদহের আখেনুর রহমান। আতঙ্কের সুরে তাঁরা বলছেন, ''আর ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাব না।''
বিগত কয়েক বছর ধরে ওড়িশায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন সুতি থানার মধুপুরের বাসিন্দা সানোয়ার হোসেন। তাঁর সঙ্গে এক ঘরেই থাকতেন নিহত পরিযায়ী শ্রমিক জুয়েল রানা ও মালদহের শোভাপুরের আখেনুর রহমান। গত ২৪ তারিখ রাতে বাংলাদেশি সন্দেহেঘরে ঢুকে ব্যাপক মারধর করা হয় তাঁদের। সেদিন রাতের অভিশপ্ত ঘটনা প্রসঙ্গে সানোয়ার জানান, ''রাত আটটার দিকে আমরা রান্না শেষ করে বিশ্রাম করছিলাম। খাওয়াদাওয়া তখনও করিনি। আচমকা আমাদের ঘরে আসে কয়েকজন স্থানীয় যুবক। তারা আমাদের কাছে বিড়ি চায়। জুয়েল রানা বিড়িও দেয় ওদের। তারপরে তারা জানতে চায়, আমরা হিন্দু না মুসলিম? আমরা ভারতীয় না বাংলাদেশি? আমরা মুসলিম বলতেই ওরা আমাদের আধার কার্ড দেখতে চায়। আমরা আধার কার্ড দেখানো সত্বেও ওরা আমাদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। আমরা বাংলাদেশি বলে আমাদের উপর চড়াও হয়। আমাদের মারধর শুরু করে। লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধোর করা হয়। আমাদের আর্তনাদে পাশের শ্রমিকরা ছুটে এলে ওরা পালিয়ে যায়। আমাদের প্রথমে উদ্ধার করে প্রথমে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে মারা যায় জুয়েল।''
ওড়িশা থেকে আহত অবস্থায় মুর্শিদাবাদে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিক সানোয়ার। নিজস্ব ছবি।
সানোয়ার আরও জানান, ''আমাদের পুলিশ পরে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার জন্য। আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। সাত বছর ধরে ওড়িশায় রাজমিস্ত্রির কাজ করছি, সম্বলপুরে প্রায় একবছর ধরে কাজ করছি। কখনো এধরনের ঘটনার সম্মুখীন হইনি। সংসারে অভাব-অনটনের কথা ভেবে ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে নৃশংস ঘটনার শিকার হয়েও জীবন হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছি। তা ঈশ্বরের অপার করুণায়। আর কখনও ভিনরাজ্যে কাজে যাব না।''
সানোয়ারের বাবা মরফুল শেখ বলেন, ''আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে আশায় আমরা খুশি। সম্বলপুরে ওদের বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। কিন্তু ওখানে ওদের কোনও চিকিৎসা পরিষেবা সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি। ও ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না। আতঙ্কের ঘোর এখনও কাটেনি। মাস দু'য়েক আগে বাড়ি থেকে সম্বলপুরে কাজে গিয়ে এই অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন হাতে করে বাড়ি ফিরে এসেছে সানোয়ার।''
অন্যদিকে একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়ি ফিরেছেন মালদহের বৈষ্ণবনগরের যুবক আতিউর হোসেন। তাঁর বাবা আমির হোসেন জানান, গত তিন বছর ধরে তাঁর ছেলে ওড়িশার সম্বলপুরে রাজমিস্ত্রি হিসাবে কাজ করছিল। ছেলে আক্রান্ত হয়েছে শুনে খুব আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন তিনি। আক্রান্ত শ্রমিকের বাবা বলেন, "ছেলেকে যে ভাবে মারধর করা হয়েছে, তাতে সে ভবিষ্যতে ঠিকমতো চলাফেরাই করতে পারবে কি না, বুঝতে পারছি না।"
