shono
Advertisement
Jammu and Kashmir

রক্তে ভেজা উপত‌্যকায় নির্বাচনী ঝড়, পড়তে পারে রেকর্ডসংখ্যক ভোট

কাশ্মীর কখনও অবাক করা থামায় না।
Published By: Biswadip DeyPosted: 02:13 PM Sep 20, 2024Updated: 02:13 PM Sep 20, 2024

কাশ্মীর উপত্যকায় এক দশক পেরিয়ে প্রথমবারের মতো বিধানসভা নির্বাচন চলছে। বহুল প্রতীক্ষিত এই নির্বাচন! রেকর্ডসংখ্যক ভোট পড়তে পারে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, যঁারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হিসাবে পাথর এবং বুলেটকেই একমাত্র পথ হিসাবে দেখে আসছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, ভোটের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতা অনেক বেশি কার্যকর। লিখেছেন রাজদীপ সরদেশাই

Advertisement

কাশ্মীর কখনও অবাক করা থামায় না। আর, ২০২৪ বিধানসভা নির্বাচনেও তার ব‌্যত‌্যয় ঘটেনি। আমরা সেদিন বিজবেহারা-র পথে। অনন্তনাগ জেলার এই শহরে ছিল পিপল্‌স ডেমোক্র‌্যাটিক পার্টির নেত্রী ইলতিজা মুফতির নির্বাচনী ক‌্যাম্পেন। শহরে ঢোকার আগে বিচ্ছিরি জ‌্যামে ফঁাসলাম। আর কর্কশ আওয়াজ বাইরে। অদ্ভুত একটা যান্ত্রিক স্বর ভেসে আসছে– অদূরে বিশাল সংখ‌্যক জনতা ছুটে যাচ্ছে একটা দিকে! প্রথমে তো ভাবলাম, নির্ঘাত কোনও বোমা পড়েছে, কিংবা কোনও জঙ্গি হামলা হল বুঝি– তাই হঠাৎ জনজীবন এমন বিঘ্নিত, হুড়োহুড়ি দশা! আমাদের ড্রাইভারদাদা যদিও হেসে বললেন– আরে ঘাবড়াবেন না, লোকে আসলে ছুটছে বিজবেহারা প্রিমিয়ার লিগ-এর ফাইনাল দেখবে বলে! বিজবেহারা বনাম শ্রীনগর খেলা চলছে! পাড়ার মাঠ, আর সেখানে ক্রিকেট-পাগল জনতা গিজগিজ করছে ভিড়ে– এহেন দৃশ‌্য সম্ভবত ‘নয়া’ কাশ্মীরের অন‌্যতম জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত।

আরও কিছু উল্লেখযোগ্য দৃশ্য রয়েছে। আমরা শ্রীনগরের হৃদয়, ঐতিহাসিক লাল চকে দঁাড়িয়ে তখন। পুলকিত দোকানদাররা আমাদের জানালেন, খুব শীঘ্রই এই চত্বরে ‘বার্গার কিং’, ‘ডমিনোজ’-এর মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি খুলতে চলেছে। এককালে, কাশ্মীরের রাজধানী শহরের বাণিজ্য কেন্দ্র, এই লাল চকেই, বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত বন্‌ধ ডাকা মাত্র, দোকানগুলো তাদের ঝঁাপ বন্ধ করে দিত। কিন্তু, গত পঁাচ বছর ধরে, সূ্র্য পশ্চিমে তার শাটার নামালেও দোকানগুলো খোলা থাকছে আলোময় হয়ে। শ্রীনগরে আমরা যেখানে ছিলাম, সেই হোটেলের মালিক গর্বের সঙ্গে জানালেন, ২০২৩-’২৪-এ এখনও অবধি তঁার সেরা ব্যবসা হয়েছে। কোভিডের সময় তিনি ভেবেছিলেন, তঁার এই সম্পত্তি বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু এখন পর্যটকের ঢল দেখে তিনি যারপরনাই আপ্লুত। উন্নত মহাসড়ক সংযোগ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ– কাশ্মীরকে দেখে মনে হবে, সব একদম সঠিক পথেই এগচ্ছে।

তা, সুদিনের আলেয়া কাটতেও বেশিক্ষণ সময় লাগল না। শ্রীনগরের শহরতলির জামা মসজিদে এলাম এরপর। শুক্রবার ছিল সেদিন। নমাজ সদ্য শেষ হয়েছে। অতীতে, শুক্রবার তথা জুম্মাবারের নমাজের পর প্রায়ই পাথর ছোড়ার ঘটনা ছিল এখানের নৈমিত্তিক। এখন আর তা হয় না। জোরদার পুলিশি ব্যবস্থার মধে‌্য, মানুষ মসজিদ থেকে শান্তভাবে বেরিয়ে আসছে। এও এক ভরসাজনক দৃশ্য। সবই ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল। কিন্তু, যে-ই না আমি ক্যামেরা চালু করলাম এবং জনতার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম– কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর ধেয়ে এল আমার দিকে।

‘বলুন, যদি কাশ্মীরে সব ঠিকঠাকই থাকে, তাহলে মিরওয়াইজ ফারুক (হুরিয়ত নেতা) কেন গৃহবন্দি?’ এক বৃদ্ধ মানুষ মেজাজ নিয়ে বললেন। ‘আমরা চুপ আছি মানে এই নয়, যা হচ্ছে তা মেনে নিয়েছি। দিল্লি আমাদের রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে আমাদের শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে,’ আরও এক ক্ষুব্ধ কণ্ঠের বিস্ফার! ‘আমরা ভয়ে-ভয়ে বেঁচে আছি, কিছু বললেই আমাদের জেলে পাঠানো হবে,’ চিৎকার করে বললেন এক বিশালদেহী মানুষ। পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের একজন সহায়ক অফিসার আমাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। অফিসার আমাদের মনে করিয়ে দিলেন– বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে গেলেও, বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা কিন্তু এখনও মরে যায়নি।

এহেন বৈপরীত‌্যময় পটভূমিতে কাশ্মীর উপত্যকায় এক দশক পেরিয়ে প্রথমবারের মতো বিধানসভা নির্বাচনের আয়োজন হচ্ছে। এবং এটি বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচন! রেকর্ডসংখ্যক ভোটার উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, যঁারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হিসাবে পাথর এবং বুলেটকেই একমাত্র পথ হিসাবে দেখে আসছিলেন, তঁারা বুঝতে পেরেছেন যে, ভোটের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতা অনেক বেশি কার্যকর।

রাজনৈতিক দলগুলোও বুঝে গিয়েছে যে, ৩৭০ ধারা বাতিলের পরবর্তী পরিস্থিতিতে গোয়ার্তুমির খুব বেশি জায়গা নেই। আন্দাজ করতে অসুবিধা হবে না– কেন ওমর আবদুল্লা প্রাথমিকভাবে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার কথা বলার পরেও অবশেষে দু’টি আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর-এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, মেহবুবা মুফতি নির্বাচনী লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও, তিনি তঁার সাহসী মেয়ে ইলতিজাকে প্রথমবার প্রার্থী হতে উৎসাহিত করেছেন। কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপির উপস্থিতি নামমাত্র হলেও, কংগ্রেস বেশ আশাবাদী রাহুল গান্ধীর ‘মহব্বত কি দুকান’ বার্তাকে সঙ্গী করে। কংগ্রেসের আশা, এই বার্তা এমন রাজনৈতিক পরিবেশে গভীরভাবে অনুরণিত হবে। কারণ, এই উপত‌্যকায় সত্যিকার অর্থে নিরাময় স্পর্শের প্রয়োজন।

তবে এবারে, উপত্যকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক বংশপরম্পরায় প্রভাবিত মূলধারার দলগুলোই নেক পর্যবেক্ষণে থাকছে না। শিরোনাম কেড়ে নিচ্ছে ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও, যারা রাজনৈতিক খেলায় নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করছে। চলতি বছরের মে মাসে, উত্তর কাশ্মীরের বারামুলা লোকসভা আসনে, স্বাধীন প্রার্থী হিসাবে শেখ আবদুল রশিদ, যিনি ‘ইঞ্জিনিয়ার রশিদ’ নামে অধিক পরিচিত, চমকপ্রদ জয়লাভ করেছেন। যঁাকে-তঁাকে নয়, ওমর আবদুল্লা এবং সাজ্জাদ লোন-এর মতো বাঘা রাজনীতিকের দুই লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন তিনি। ২০১৯ সাল থেকে রশিদ তিহার জেলে বন্দি, সন্ত্রাসী ফান্ডিং মামলায় ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত তিনি। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় তঁার ‘যুদ্ধং দেহি’ স্লোগান ছিল ‘তিহার কা বদলা ভোট সে’, অর্থাৎ, ভোট দিয়েই তিহারে জেলবন্দির বদলা নেওয়া হবে! এখন, নিজেকে নির্দোষ দাবি করা রশিদ তিন সপ্তাহের জামিন পেয়েছেন নির্বাচনী প্রচারের জন্য এবং তঁার ‘আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি’ ৩৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তিনি এমনকী নিষিদ্ধ দল ‘জামাত-এ-ইসলামি’-র সঙ্গে একটি ‘কৌশলগত’ জোট গড়েছেন, যা অনেকেরই ভ্রুকুঞ্চনের কারণ। জামাত-সমর্থিত একগুচ্ছ স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং একজন ইউএপিএ-অভিযুক্তর দলভারিক্কি কি প্রধান খেলোয়াড়দের, বিশেষত ন্যাশনাল কনফারেন্স-কংগ্রেস জোটকে চ্যালেঞ্জ করার একটি চেষ্টা, যাতে ডাল লেকের জল ঘোলা করা যায়?

কেন্দ্র আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, তীব্র বহুকৌণিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আদপে শক্তিশালী গণতন্ত্রের প্রতিফলন। এক অর্থে, এই নির্বাচন সম্ভবত ১৯৭৭ সালের পর কাশ্মীরের সবচেয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ১৯৭৭-এই শেখ আবদুল্লা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বিজয়ী প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। ভোট বয়কট, কম ভোটার উপস্থিতি এবং কারচুপির অভিযোগের দিনকাল এখানে অতীত। উল্টে এই নির্বাচন অনেক বেশি উদ্দীপ্ত এবং প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে।

তবুও স্বীকার না-করে উপায় নেই, বাহ্যিক উদ্দীপনার আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর এক অন্তর্দ্বন্দ্ব– ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এমন এক বিধানসভা গঠিত এই অঞ্চলে, যার ক্ষমতা একটি পৌরসভার চেয়েও কম। এমন একটি সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যা উপত্যকার পরিবর্তে জম্মুর প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়েছে। প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে এমন একজন অনির্বাচিত লেফটেন্যান্ট গভর্নর দ্বারা, যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। কাশ্মীর এখনও স্থবির এক ঝড়ের মধ্যে যেন আটকে– যেখানে কেউ-ই সত্যি সতি‌্য স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে চায় না। চায় না প্রয়োগ করতে গণতন্ত্রের প্রকৃত জোর। কারণ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যেতে পারে। সকলেরই মনে ভয়!
২০০৩ সালে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর উজ্জীবিত স্লোগান ‘কাশ্মীরিয়ত, ইনসানিয়ত, জমহুরিয়ত’ (অন্তর্ভুক্তি, মানবিকতা, গণতন্ত্র) অনেক কাশ্মীর পর্যবেক্ষকের মনে অনুপ্রাণনের ঢেউ তুলেছিল। তবে, কাশ্মীরিয়ত কবরস্থ হয়েছিল যখন ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাড়িছাড়া হতে বাধ‌্য করা হয়। ইনসানিয়তের মৃতু‌্য ঘটে, যখন অনেক নিরীহ মানুষ সন্ত্রাসীদের বন্দুক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অত্যাচারের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। জমহুরিয়ত বছরের পর বছর ধরে আইসিইউ-তে চেতনাহীন, কারণ, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের জায়গা তো প্রায় নেই-ই। দুর্ভাগ্যবশত, তুরিভেরি-সমৃদ্ধ এমন দামামাময় নির্বাচনী প্রচার রক্তে ভেজা উপত্যকার বাস্তবতাকে বদলাতে পারবে না।

পুনশ্চ যেহেতু লেখাটা শুরু করেছিলাম ক্রিকেট ঘিরে এক আশার উদ্দীপনকে সঙ্গী করে, তাই কাশ্মীরেরই আরও একখান ক্রিকেটগন্ধী গল্প দিয়েই না-হয় শেষ করি। সেদিন, বিজবেহারায় ক্রিকেটোন্মত্ত জনগণের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তা, কথার মাঝে, ভিড়কে উদ্দেশ‌্য করে ‘আপনাদের ফেভারিট ক্রিকেটার কে?’ প্রশ্নটি ছুড়ে দিলাম। কেউ বলে উঠল ‘বিরাট কোহলি’, কেউ আওয়াজ তুলল ‘জসপ্রীত বুমরা’, কেউ-বা ‘রোহিত শর্মা’ ধ্বনি তুলল। কিন্তু, একাধিক মানুষ বলে উঠল, ‘বাবর আজম’, পাকিস্তানের খ‌্যাত ব‌্যাটার, অধিনায়কও। এহ বাহ‌্য, কাশ্মীরে সীমান্তরেখার চূড়ান্ত ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ যতই থাকুক, কিছু ব‌্যাপারে সীমা ছাড়াবেই!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • কাশ্মীর উপত্যকায় এক দশক পেরিয়ে প্রথমবারের মতো বিধানসভা নির্বাচন চলছে।
  • বহুল প্রতীক্ষিত এই নির্বাচন! রেকর্ডসংখ্যক ভোট পড়তে পারে।
  • ধরে নেওয়া যেতে পারে, যঁারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হিসাবে পাথর এবং বুলেটকেই একমাত্র পথ হিসাবে দেখে আসছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, ভোটের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতা অনেক বেশি কার্যকর।
Advertisement