কেন্দ্রে সরকার একদিকে যেমন জোট যুগে প্রবেশ করেছে, অন্যদিকে বিরোধীদেরও রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক পরিসর বেড়েছে। সংসদে প্রয়োজন শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে পলিটিক্যাল সিমবায়োসিস। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
ছেলেবেলায় পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলার সময়, রকের উপর ইটের ছোট্ট টুকরো দিয়ে লম্বা-লম্বা দাঁড়ি টেনে তার উপর সংখ্যা চিহ্নিত করতাম, ১-২-৩-৪। এরপর ব্যাট দিয়ে সংখ্যাগুলো আড়াল করে দেওয়া হত। উলটেপালটে লেখা সংখ্যাগুলোর উপর আঙুল রাখতাম আমরা। তারপর ব্যাট তুলে দেখা হত– কে প্রথম, সে ওপেনিং ব্যাটসম্যান। তারপর কে দ্বিতীয়, কে তৃতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, একেই বলে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র এমন একটি ভাবনা যা রান্নাঘর থেকে দুর্গাপুজো কমিটি, ভোট থেকে সংসদ তথা সরকার, রাষ্ট্র, সর্বত্রগামী।
অষ্টাদশ লোকসভা গঠিত হল। ওম বিড়লা স্পিকার হলেন। এ ঘটনায় বিস্মিত হইনি। কিন্তু অবাক হলাম বহু যুগ পর স্পিকার সর্বসম্মতভাবে মনোনীত হলেন না, তা দেখে। সংসদের সর্বোচ্চ চেয়ারটি নিয়েও প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই হল। হতে পারে তা প্রতীকী, হতে পারে ধ্বনিভোট, কিন্তু মনে হল, শুরুর চিত্রনাট্যটি তো অন্যরকমও হতে পারত। বিরোধীরা বলছে, সরকারের অনমনীয় মনোভাবের জন্য তারা প্রার্থী দিতে বাধ্য হয়েছে শেষ মুহূর্তে।
গণতন্ত্র মানে কি সংখ্যা? শুধুই সংখ্যা?
বিগত লোকসভা নির্বাচনে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে শাসক দলের সংখ্যা ছিল ৩০৩। আর এবার ২০২৪-এ তা ২৪০। বর্তমানে কেন্দ্রে এনডিএ জোটের সরকার। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ মানে তো কেবল আর সংখ্যা নয়। গণতন্ত্র হল একটি ভাবনা। গণতন্ত্র মানে নাগরিক সচেতনতা, গণতন্ত্র মানে মানবিকতা।
[আরও পড়ুন: ১০ টন নষ্ট খেজুর ধাপায় ফেলতে চেয়ে চিঠি ব্যবসায়ীর, আপত্তি পুরসভার]
প্রথম ধাক্কা প্রোটেম স্পিকার মনোনয়ন নিয়ে। বিরোধীদের দাবি ছিল, প্রথা মেনে সংসদের সবচেয়ে প্রবীণ সাংসদ কে. সুরেশকে করা হোক প্রোটেম স্পিকার। বিজেপি তা শুনল না। নানা যুক্তি দিয়ে বিজেডি থেকে বিজেপিতে আসা ভর্তৃহরি মোহতাব-কে এই অস্থায়ী সভা পরিচালক করা হল। সংসদীয় মন্ত্রী কিরণ রিজিজু নাকি বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। আবার প্রথা মেনে দাবি তোলা হল, স্পিকার যদি বিজেপির হন, তবে ডেপুটি স্পিকার কংগ্রেস বা বিরোধীদের হোক। না বিজেপি এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করল। বিরোধীদের জানিয়ে দেওয়া হল, স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার দু’টি পৃথক বিষয়, পৃথক নির্বাচন। এখনও বিরোধীদের দাবি, গণতন্ত্রর পক্ষে শক্তিশালী বার্তা দেওয়া হোক বিরোধী সাংসদকে এ পদ দিয়ে। তবে এখনও বিজেপি এ পদটি রাখতে আগ্রহী।
লোকসভা অধিবেশনের প্রথম দিনে সংসদে প্রবেশের আগে প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিলেন ‘জরুরি অবস্থা’-র কথা। ভারতীয় গণতন্ত্রর সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। সঙ্গে তিনি শক্তিশালী গণতন্ত্রর কথাও বললেন। ‘জরুরি অবস্থা’-কে মনে রাখা প্রয়োজনীয়তার কথাও উঠল। তবে নরেন্দ্র মোদি কেন বারবার জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেসকে বিদ্ধ করতে চাইছেন তা বোঝা খুব কঠিন নয়। তবে এ তো অনস্বীকার্য যে, বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি না থাকলেও অঘোষিত একনায়কতন্ত্র সদর্পে বিরাজমান। কারণ, এবার কেন্দ্রে জোট সরকার বসলেও, বা মোদি মুখে ‘আমরা-আমরা’ করলেও, তঁার মনোভাব ও সার্বিকভাবে বিজেপির সিদ্ধান্তে ইতিমধ্যেই ‘আমি-আমি’ ভাব প্রকট। কিন্তু এই ‘জরুরি অবস্থা’ জারি না করেও শাসক যদি কর্তৃত্ব-বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে মরিয়া হয়, তবে তা অবশ্যই বাহুবলি আচরণের নমুনা।
‘জরুরি অবস্থা’ জারি না করেও, রাজ্যে ৩৬৫ ধারা জারি না করেও, কীভাবে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র রচনা করা যায়– তা আমরা গত দশ বছর ধরে দেখছি। এমনকী, সমগ্র বিশ্বজুড়েই যে এই নির্বাচিত একনায়কতন্ত্রর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তা-ও দৃশ্যমান।
[আরও পড়ুন: শপথ ইস্যু: মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়েরের পথে রাজ্যপাল]
তবু আশার কথা, দশ বছর পর হলেও ভারত সংসদে বিরোধী দলনেতা পেয়েছে। রাহুল গান্ধীর জন্যও এ এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। স্পিকার নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সংসদীয় রীতি মেনে ওম বিড়লাকে তাঁর চেয়ারে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে এসেছেন। এত দিন সংসদ মানেই ছিল একক এবং অদ্বিতীয়ম নরেন্দ্র মোদি। এখন দেখা যাবে মোদি বনাম রাহুল। পদে-পদে বিজেপি তাঁকে ব্যর্থ প্রমাণিত করতে চাইবে।
যুক্তি, বুদ্ধি, বাগ্মিতা, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ থাকা– রাহুল গান্ধীর সামনে
এখন অনেক অনেক পরীক্ষা।
তবু ১৪০ কোটি মানুষের একজন হয়ে আশা করব এবার আমরা সংসদে আলোচনা দেখতে পাব। শাসক বিজেপি এবং তাদের জোট আর বিরোধী কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে কথোপকথনের রাজনৈতিক পরিসর দেখা যাবে। বিরোধী শিবির সংসদীয় গণতন্ত্রের এক শক্তিশালী স্তব্ধ। বিজেপির সদর্প ঘোষণা ও প্রত্যাশা ছিল কংগ্রেস-মুক্ত ভারত নির্মাণ। এবারের ভোটের আমজনতার রায় আর যা-ই হোক বিরোধী-মুক্ত, কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার পক্ষে যে নয়– তা স্পষ্ট। বরং এটাই আবারও প্রমাণিত হল, সাধারণ মানুষ একনায়কতন্ত্রী অহংকার পছন্দ করে না। ভারত এক বহুত্ববাদী দেশ, নানা ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান– মানুষের দেশ। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের রাষ্ট্র নয়।
বিগত লোকসভায় দেখেছি, বিরোধী-শূন্য সংসদে সরকার আলোচনা ছাড়াই একতরফা বিল পাস করে চলেছে। ১৪৬ জন সাংসদকে একদিনে বহিষ্কার করা হয়েছে। মহুয়া মৈত্র-র মতো সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁর বক্তব্য সংসদে শোনার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
তৃতীয়বারের জন্য নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও কি বিজেপির পক্ষ থেকে আপাত উদার মানসিকতার নজির সেভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? আসন সংখ্যার অভাবে বিজেপি সরকার নিরুপায় হয়ে এনডিএ সরকার গঠন করেছে বটে, কিন্তু ২৪০ আসনের বিজেপি– মন্ত্রিসভায় দলীয় দাপট অক্ষুণ্ণ রাখছে। শুধু মন্ত্রিসভার বিগ-ফোর নয়, শুধু স্পিকার নির্বাচন নয়, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐকমত্য রচনার প্রয়াসেও, উদারতার কোনও ইঙ্গিত কি আদৌ আমরা দেখতে পাচ্ছি? অনুদারতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ কেন্দ্রীয় সরকারে কোনও মুসলিম মুখ না-থাকা। সংসদ সারা বছর ধরে হয় না, নির্বাচিত সময়ই হয়। কিন্তু সংসদের অধিবেশনে বিল পাস ও বিভিন্ন বিতর্কে বিরোধীদের কতটা সময় ও গুরুত্ব স্পিকার দেবেন সেটাও দেখার।
ওম বিড়লার জন্য এ এক বড় চ্যালেঞ্জ! এত দিন বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারে বিরোধী দলনেতারই কোনও পদ-ই ছিল না। এবার কিন্তু সরকার একদিকে যেমন জোট-যুগে প্রবেশ করেছে, অন্যদিকে বিরোধীদেরও রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক পরিসর বেড়েছে। সংসদে প্রয়োজন শাসক ও বিরোধীদের মধে্য পলিটিক্যাল সিমবায়োসিস। দু’-পক্ষই দু’-পক্ষের উপর নির্ভরশীল হবে, সেটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শ অবস্থা। এক্ষেত্রে বিরোধীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সংসদ চলতে না দেওয়া, গোলমাল করে টিভি চ্যানেলের হেডলাইন কেড়ে নেওয়াই বিরোধীদের একমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের পথ হতে পারে না। আবার শাসক সরকার এবং সর্বোপরি স্পিকার মশাইকেও অনমনীয় নয়, উদার হতে হবে। তা না হলে বিরোধীরাও অসহিষ্ণু হবে। এই কঠিন ভারসাম্য স্পিকার না রাখতে পারলে এবার কিন্তু বিরোধী শিবির হয়ে উঠবে আরও আক্রমণাত্মক।
[আরও পড়ুন: প্রশ্ন ফাঁস বিতর্কের মাঝেই কোটায় ফের ছাত্র-আত্মহত্যা! নিট পরীক্ষার্থী? বাড়ছে চাঞ্চল্য]
সমগ্র বিশ্বজুড়েই এখন গণতন্ত্র সংকটে। ২০২৪ সালে পৃথিবীর নানা ছোট-বড় দেশে নির্বাচন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সামগ্রিকভাবে নির্বাচনী রাজনীতি ব্যর্থ। উদারবাদী গণতন্ত্রর মধ্যে মানুষের ইচ্ছের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে না। বদলে এক বিশেষ ধরনের অভিজাততন্ত্রের আধিপত্যকামিতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শক্তিশালী হয়ে উঠছে এক নতুন মিডিয়া– ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়া। সাংবাদিক বৈঠকের প্রাসঙ্গিকতা ফুরচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে এখন রচিত হচ্ছে রাজনৈতিক পরাবাস্তবতা। সঙ্গে পারসেপশন তৈরির রাজনীতি। সতে্যর চেয়েও তার শক্তি বেশি এই উত্তরসত্য যুগে। রাইট উইং হোক বা লেফট উইং– ‘পপুলিজম’ সত্য। পপুলিজম মানে জনপ্রিয়তার পথ, কিন্তু তা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতন্ত্রের পথ?
গণতন্ত্র যখন নৈরাজ্য ডেকে আনে, বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, ‘বহুত্ববাদ’-এর নামে শুরু হয়ে যায় অচেতন ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’, তখনই গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে জাগ্রত হয় একনায়কতন্ত্র। চিন, রাশিয়া, ইরান, তাজিকিস্তান, ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোও দাবি করে তারা গণতন্ত্রর পূজারি। আমেরিকা-ব্রিটেনও বলে ‘জয় গণতন্ত্র’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিষয়ক অধ্যাপক বেন আনসেল ব্যঙ্গ করেই বলেছেন– ‘দেয়ার ইস নো সাচ থিং অ্যাজ দ্য উইল অফ দ্য পিপল।’ আজ নাকি এটার কোনও অস্তিত্বই নেই!
হায়, মহামতি রুশো থাকলে কী বলতেন?
তবু ভারতে আমরা আশাবাদী হতে পারি– এখনও এই দেশে গণতন্ত্র রক্ষার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প-ও যে নেই আমাদের, আমজনতার।