shono
Advertisement
Donald Trump

‘কমেডি অফ এররস’

ট্রাম্প-জেলেনস্কির ‘হিটেড কনভারসেশন’ আপাতত শিরোনামে।
Published By: Biswadip DeyPosted: 03:28 PM Mar 07, 2025Updated: 03:28 PM Mar 07, 2025

ট্রাম্প-জেলেনস্কির ‘হিটেড কনভারসেশন’ আপাতত শিরোনামে। প্রকাশ্যে যে ‘কৃতজ্ঞতা’ মনে করিয়ে দেওয়া যায়, তা আরও একবার দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘আইকন’ দেখিয়ে দিলেন। ট্রাম্পের সঙ্গে মহম্মদ ইউনুসের সাক্ষাৎও যদি এমন আবহে হয়! লিখলেন সুমন ভট্টাচার্য

Advertisement

কেউ আমেরিকা গেলে ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্ট্রি’-তে যাবেই। এবং সেখানে এত দিন পর্যন্ত মার্কিনিরা একটা ছবি গর্ব করে বাঁধিয়ে রেখেছিল।

গত শতকে, ১৯৮৭ সালে, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের চুক্তি সইয়ের সেই ঐতিহাসিক ফ্রেম। ঠিক জানা নেই এখন বা কিছু দিন বাদে মস্কো গেলে– সেখানকার কোনও মিউজিয়ামে ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির ওভাল অফিসে বিখ্যাত বৈঠকের ছবি টাঙানো থাকবে কি না। কারণ, এত দিন রুশরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করে এসেছে আমেরিকার কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের হেরে যাওয়া বা ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র অবসানের সেসব দিন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজের বজ্রমুষ্টিকে আলগা করেছিল, এবং ইউরোপে একের পর এক কমিউনিস্ট-শাসিত দেশের পতন হচ্ছিল, তাকে রুশরা চিরকাল আপন ‘পরাজয়’ হিসাবেই দেখে এসেছে। কিন্তু ওভাল অফিসে বসে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে পুতিনের বিজয়কেতন উড়িয়ে দিলেন, তার ছবি মস্কো কীভাবে সাজিয়ে রাখবে, সে বিষয়ে অবশ্যই জল্পনা থাকবে। এটা নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের উপর মস্কোর নিখুঁত এবং মধুর প্রতিশোধ!

উত্তর শহরতলির যেখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে, সেই বরাহনগর অঞ্চলে এখন থেকে চার দশক আগে মাঝে-মাঝে সালিশি সভা বসত। তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএমের নেতারা বিবাদ মেটাতে হয়তো প্রোমোটার এবং প্রোমোটার যে-উদ্বাস্তুদের জমি দখল করতে চাইছে– দুই পক্ষকেই ডেকে পাঠাত। কিন্তু পুরনো পাড়ায় খোঁজ নিয়েও কেউ বলতে পারল না, তৎকালীন কোনও দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাও এইভাবে কোনও সালিশি সভার ইতি টেনেছেন কি না, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প ওভাল অফিসে বসে করে দেখালেন। পাড়ার পচাদা কিংবা ভজাদা-ও যেভাবে কোনও সমস্যার সমাধান করেন না, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তঁার ভাইস প্রেসিডেন্ট– মার্কিন মুলুকের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব– সেভাবেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সংলাপ সেরেছেন।

সিপিএমের পার্টি অফিস থেকে বেরনোর সময় প্রোমোটার এবং উদ্বাস্তু কলোনির জমির মালিকদের যতখানি বিধ্বস্ত দেখাত, জেলেনস্কিকে তার চেয়েও বেশি বিধ্বস্ত দেখিয়েছে। এবং সময়ের ব্যবধানে তিনি আরও নতজানু হয়ে ট্রাম্পের নেতৃত্বেই ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কাজ করার কথাও ঘোষণা করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কি বরফ গলবে? ট্রাম্প কি জেলেনস্কিকে ক্ষমতায় রেখে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং সীমানাকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় থাকবেন? আপাতত তা অজানা।

‘অজানা’ কারণ, স্মরণ-কালের মধ্যে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এইভাবে ক্রেমলিনের সুরে কথা বলেছেন, এমনটা দেখলাম কোনও কূটনীতিবিদ, কোনও দেশের রাষ্ট্রনায়কও, মনে করতে পারছেন না। ট্রাম্প মানেই যে দুর্দান্ত ‘প্রহেলিকা’, ট্রাম্প মানেই যেসব অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা, তা আর একবার নতুন প্রেসিডেন্ট ওভাল অফিসে বসেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। ট্রাম্পের এহেন আচরণে ইউরোপে ‘ন্যাটো’-র কী হবে, ইউরোপে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে বাকি দেশেরা কী ব্যবস্থা নেবে, সেই প্রশ্ন অবশ্যই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে তোলপাড় করছে। কিন্তু ট্রাম্প স্পষ্ট কথায় যেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং জেলেনস্কি যেটা মেনেও নিয়েছেন যে, ‘হঁাটু মুড়ে আনুগত্য’ প্রকাশ করলে, তবেই এই মার্কিন প্রভুর কাছ থেকে সামান্য ‘বিস্কুট কিংবা পাঁউরুটি’ পাওয়া যেতে পারে।

প্রকাশ্যে দুনিয়ার সব টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এভাবে যে কাউকে ‘কৃতজ্ঞতা’ মনে করিয়ে দেওয়া যায়, বা বলা যায়, ‘তুমি আমার দাসানুদাস’, তা আরও একবার দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘আইকন’ দেখিয়ে দিলেন। অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতি পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা বোধহয় ট্রাম্প-পুতিনের সখ্য এবং নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মপদ্ধতি আমাদের প্রতি মুহূর্তে জানান দিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে আসার আগে বা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে জেলেনস্কির নিজের দেশে বিরাট খ্যাতি ছিল কৌতুকাভিনেতা হিসাবে। কিন্তু সম্ভবত এরকম কমেডি বা আসলে ট্র্যাজেডি তিনি নিজেও কোনও দিন চিত্রনাট্য হিসাবে লেখেননি।

তঁার সঙ্গে বা ইউক্রেনের জনগণের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে-ব্যবহারটি করেছেন, তা অন্তত বহু শতক ধরে কূটনীতির ইতিহাসে খারাপতম উদাহরণ হিসাবে রয়ে যাবে। এবং আমেরিকাকে বিশ্বাস করলে কী হতে পারে, তার প্রমাণ যদি আফগানিস্তান থেকে পালানো আশরাফ গনি, সে-দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রত্যহ বলে থাকেন, বা আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার হেলিকপ্টারে উঠে তঁার তড়িঘড়ি পলায়ন আমাদের স্মরণে থাকতে পারে, তাহলে ইউক্রেনকে কীভাবে রাশিয়ার সামনে নতজানু হতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাধ্য করলেন, সেই উদাহরণও ইতিহাসে রয়ে যাবে। ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও কেউ আমেরিকার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ করার আগে এবং আমেরিকার কথায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পা ফেলার আগে– অন্তত ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির এই স্মরণীয় ১০ মিনিটেরও কম সময়ের টেলিভাইসড কথোপকথন মনে রাখবেন।

ওয়াশিংটনের ওভাল হাউসে বসে কে কথা বলছিলেন, ভ্লাদিমির পুতিন না ডোনাল্ড ট্রাম্প– সেটা নিশ্চয়ই বিশ্বের অনেকেই ভেবেছেন। জেলেনস্কি তো ভেবেইছেন। আর আমেরিকার মননে কতটা ধাক্কা দিয়েছে, তা বুঝতে গেলে অস্কার সন্ধ্যায় সঞ্চালকের ওই বিখ্যাত কথাটা মনে রাখতে হবে। ‘শেষ পর্যন্ত আমেরিকানরা অন্তত একজনকে পেল, যিনি, রুশ ক্ষমতাধরদের সামনে মুখ তুলে কথা বলবেন’। বছরের সেরা ছবি হিসাবে নির্বাচিত ‘আনুর’-এর নায়িকার কথা ভেবেই অস্কার সন্ধ্যায় সঞ্চালকের এই কথা।

সব খারাপেরই অন্য দিক থাকে, সব মুদ্রারই আলাদা পিঠ। এটা চিন্তা করতে গিয়ে ভাবলাম, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের অধুনা সরকার প্রধান মহম্মদ ইউনুস কবে দেখা করতে যাবেন? আর সঙ্গে করে কি তিনি তঁার বিখ্যাত সমন্বয়ক বা আইনি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রমুখদের নিয়ে যাবেন? ইউনুস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই ভবিষ্যতের সাক্ষাৎকারের দিকে তাকিয়ে থাকব। ঠিক কীভাবে অতি দক্ষিণপন্থী ‘আইকন’ তঁার পূর্বসূরি জো বাইডেনের করা একটি ভুলকে সংশোধন করার কথা ঘোষণা করতে পারেন, তা আপাতত অনুমান করেই রোমাঞ্চ জাগছে।

ট্রাম্প-জেলেনস্কির সাক্ষাৎকার, কথোপকথন, বাইডেনকে দোষারোপ, নিজে কবে ইউক্রেনকে জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছেন– এসব ধাপে ধাপে মনে করিয়ে দেওয়ার আখ্যান থেকে অন্তত বাংলাদেশে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর আন্দাজ করে নেওয়া উচিত– কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্বের ভুল সংশোধন করে নেওয়ার কথা তঁার মতো করে ভাবেন, বা কীভাবেই-বা তিনি পর-রাষ্ট্রনীতি পরিচালিত করেন।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ট্রাম্প-জেলেনস্কির ‘হিটেড কনভারসেশন’ আপাতত শিরোনামে।
  • প্রকাশ্যে যে ‘কৃতজ্ঞতা’ মনে করিয়ে দেওয়া যায়, তা আরও একবার দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘আইকন’ দেখিয়ে দিলেন।
  • ট্রাম্পের সঙ্গে মহম্মদ ইউনুসের সাক্ষাৎও যদি এমন আবহে হয়!
Advertisement