কত বছর চলে গিয়েছে জীবন থেকে, তারা কি সত্যিই লুপ্ত? মরেছে শীতল অন্ধকারে? না কি থেকে যাবে নিঃসঙ্গ অতীত-সঞ্চারে।
২০২৫ আজ শেষ হতে চলেছে। আগামী কাল উঠবে ২০২৬-এর প্রথম সূর্য। ১৮৫০-এর শেষে, ‘ইনমেমোরিয়াম্’ কাব্যগ্রন্থে ‘রিং আউট, ওয়াইল্ড বেল্স’ কবিতায় কী সহজে, প্রায় আজ্ঞার ভঙ্গিতে, ভিক্টোরিয়ান ইংরেজ কবি লর্ড অালফ্রেড টেনিসন লিখলেন, ‘রিং আউট, ওয়াইল্ড বেল্স, টু দ্য স্কাই’...‘দ্য ইয়ার ইজ ডাইং ইন দ্য নাইট; অ্যান্ড লেট হিম ডাই’! এই আপাত সহজ-সরল উদ্বুদ্ধ জীবনবোধের কবিতাটির বয়স ১৭৫ বছরের কম নয়। মাঝখানে ঘটে গিয়েছে দু’টি বিশযুদ্ধ। ঘটে গিয়েছে তোলপাড় পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে সরল গৌরববোধ এবং অহংয়ের উচ্চারণ এই কবিতার আশাবাদে তা এখন প্রহসন। এখন চমকে উঠতে হয় এই পঙ্ক্তিটি পড়ে: ‘দ্য ইয়ার ইজ ডাইং ইন দ্য নাইট, অ্যান্ড লেট হিম ডাই।’
টেনিসন বিদায়ী বছরকে ‘লেট ইট ডাই’ না বলে বললেন ‘যে মানুষটা মরছে, তাকে মরতে দাও, তুষার সাদা রাত্রে তাকে একা মরতে দাও। কোনওরকম মনকেমন, কোনওরকম স্মৃতিপীড়ন, মেদুরতা যেন না থাকে ওই মানুষটার জন্য। ওই মানুষটার দৈন্য, মিথ্যাচার, সংকীর্ণতা এসব থেকে তোমরা নতুন করে বেরিয়ে এসো: ‘রিং আউট দ্য ওয়ান্ট, দ্য কেয়ার, দ্য সিন’– টাকাপয়সা সোনাদানার লোভ থেকেও বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো রাজনীতির খুদে সংকীর্ণ মারামারি থেকে।
‘রিং ইন দ্য লাভ অফ ট্রুথ অ্যান্ড রাইট।’ যা সঠিক এবং সত্য– তার মধে্য বেরিয়ে এসো, বুড়ো রুগ্ণ অতীতটাকে ত্যাগ করে। এই জীবনবোধ এ যুগে অচল। মনে কি হয় না এই জীবনদর্শন যতটা নির্বোধ, ততটাই নির্মম? ২০২৫-কে একটি মানুষ বলে ভাবলে, যে আমাদের সমস্ত সুখ-দুঃখে, সমস্ত সমাহারে এবং একাকিত্বে মিলেমিশে কাটাল, তাকে কি বলতে পারব– মরো গিয়ে ওই অন্ধকার শীতল রাতে, কিচ্ছু যায় আসে না আমাদের, কারণ আমরা মনে রেখেছি তোমার পাপ, তোমার অন্যায়। তোমার যত্ন, তোমার দান কী তুচ্ছ! তোমার দৈন্য সব ঢাকা দিয়ে দিয়েছে, যাও, গিয়ে মরো একা শীতল শীতের রাতে! আধুনিক জীবনদর্শনে সঠিক-বেঠিক, সত্য-অসতে্যর বিভেদ আবছা করে দিয়েছে। ক্রমশ বুঝতে শিখেছি, প্রতিটি জীবন ন্যায়-অন্যায়ের বুননে গড়ে ওঠে। পাপ-পুণ্য ক্রমাগত অপ্রতিহত তারলে্য পরস্পরের মধে্য প্রবাহিত হয়।
কালো-সাদাকে দুটো আলাদা বাক্সে স্থান দিতে পারি না। এই বিপুল পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পুরনো বছরকে বিদায় জানাতে কষ্ট পাচ্ছি। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আমাদের মধে্য অনিশ্চয়তায় পা রাখার ভয়ও থাকছে। জীবনবোধে এই মিশ্ররাগই আধুনিকতার অভিজ্ঞান। সতি্য বলতে, এই যে ২০২৫ চিরদিনের জন্য ছেড়ে যাচ্ছে, এবং এমনই আরও কত বছর চলে গিয়েছে জীবন থেকে, তারা কি সতি্যই লুপ্ত? তারা কি থেকে যায়নি আনন্দ-বেদনার স্মৃতিতে, নিঃসঙ্গ অতীতসঞ্চারে, বিচিত্র অভিজ্ঞতার ব্যক্তিগত সম্পুটে? যখন উল্লাসে বিশ্বজুড়ে নতুন বছরকে জানাব সমবেত স্বাগত, সেই উৎসব ও উচ্চারণে কি মিশে থাকবে না নস্টালজিয়ার নিভৃত নিবেশ?
