কিশোর ঘোষ: এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-এ জন্ম পৃথিবীর, আরেক বিস্ফোরণেই কী তার সমাপ্তি! শেষের সেদিনের জন্য দায়ী থাকবে আত্মভুক মানুষ। সে যেন পুরাণ কথিত ভস্মাসুর! যা ছিল আশীর্বাদী শক্তি, তাই হয়ে গেল কাল অভিশাপ! শেষকালে নিজের মাথা স্পর্শ করে নিজেকেই ধ্বংস! মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক অশান্তি যেন সেই ভয়ংকর পরিণতির দিকে ধাবিত। একে অপরকে পরমাণু যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রলয়োল্লাস করছে ইরান ও ইজরায়েল। আগুনে ফুঁ দিচ্ছে আমেরিকা। চিন্তিত আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা। সংস্থার প্রধান মারিয়ানো গ্রসি জানিয়েছেন, ইরানের পরমাণু ঘাঁটিতে ইজরায়েলের হামলার পর যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনে আপাতকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কী ফিরে আসবে হিরোশিমা-নাগাসাকি কিংবা চেরনোবিলের মতো দুঃস্বপ্নের স্মৃতী? নাকি তার চেয়েও ভয়াল কিছুর সাক্ষী হবে মানবসভ্যতা? সবচেয়ে বড় কথা, এতে লাভ কার?
মানুষ আসলে আত্মবিস্মৃত প্রাণী, ঠিক যেন 'গজনি' ছবির আমির খান অভিনীত চরিত্র। যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবীর ইতিহাস সেই প্রমাণ দেয়। নচেৎ মাত্র ৭৫ বছরেই ভুলে গেলাম 'লিটল বয়' আর 'ফ্যাটম্যান' নামের দুটি পরমাণু বোমা কীভাবে ছাড়খাড় করেছিল জাপানের যমজ শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি! কত সহজেই হিরোশিমার ১ লক্ষ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকির ৭৪ হাজার মানুষের মৃত্যুশোক গিলে ফেললাম আমরা! এখানে শেষ নয়, পরবর্তীকালে দুই শহরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের বলি হয়েছিল যথাক্রমে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার এবং ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষ। ভাবা যায়, এহেন দুঃস্বপ্নকে ভুলে একে অপরকে পরমাণু যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে দুটি রাষ্ট্র! এরপর প্রশ্ন ওঠেই, মানুষই কি এই গ্রহের নির্বোধতম প্রাণী? চেরনোবিলের কথাই বা কী করে ভুলি!
হিরোশিমা-নাগাসাকির মতোও পুরনো নয় চেরনোবিল। সেদিনের কথা। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল। এবারে অবশ্য দুর্ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা! প্রাথমিক ভাবে ৩১ জনের মৃত্যু হলেও চেরনোবিলের বিষক্রিয়ায় ৩ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের জীবন নরক হয়ে উঠেছিল। অধিকাংশই মারণ রোগে আক্রান্ত হন, অনেক বিকলঙ্গ হয়ে পড়েন। সবচেয়ে বড় কথা, চেরনোবিল বিস্ফোরণে তদানিন্তন রাশিয়ার অংশ ইউক্রেনই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড, বেলারুশ, নরওয়ে, ইতালি, গ্রিস-সহ ১২টি দেশে তেজস্ক্রিয় দূষিত পদার্থ ছড়িয়ে পড়েছিল। বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল মাইলের পর মাইল ক্ষেতভূমি, একাধিক নদীর জল। রক্ষা পায়নি সংলগ্ন অরণ্যাঞ্চলের প্রাণীরাও। তারাও যন্ত্রণা পেয়ে একটু একটু করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। বিস্ফোরণের ৩৯ বছর পরেও চেরনোবিল মনুষ্যবর্জিত পরিত্যক্ত এক শহর। বিশেষজ্ঞদের মতে, চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রের বিস্ফোরণটি ছিল ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় আমেরিকা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত পরমাণু বোমার তুলনায় পঁচিশ গুণ শক্তিশালী। বিস্ফোরণ পরবর্তী 'মেঘ' বা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ইউক্রেন, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, এমনকী পূর্ব আমেরিকার আকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
মানবসভ্যতার মেমোরি কার্ডে রয়েছে নারকীয় এই অতীত, তারপরেও কোন মুখে ইজরায়েল বা ইরান কিংবা আমেরিকা পরমাণু যুদ্ধের কথা তোলে? তারচেয়ে বড় কথা, পৃথিবী নামের এই মহান পরিবারকে ধ্বংস করার অধিকার কে দিয়েছে জনৈক বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, সৈয়দ আলি হোসেইনি খামেনেই কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে? একই কারণে ভারত বা পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করাও এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ-দ্য ভিঞ্চি-ডিলান-আইনস্টাইন-আইজেনস্টাইন-ভ্যান গখ-ব্র্যাডম্যান-চে গুয়েভারা-পেলে-মার্কস-গান্ধী-ফ্রয়েড-বুদ্ধ-ডারউইনের এই পৃথিবীতে পরমাণু যুদ্ধে হবে কি হবে না, এককভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না কোনও রাষ্ট্রনায়কই। কারণ তার ফল ভুগতে হবে গোটা বিশ্বকে, সমগ্র জীবজগৎকে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি সত্যিই আণবিক যুদ্ধের আকার নেয় তবে নিশ্চিহ্ন হবে গাছ-পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ-মানুষের তৈরি এক পৃথিবী পরিবার। অতএব, কতিপয় রাষ্ট্রনেতার 'প্রলয়োল্লাস' কিছুতেই মেনে নেবে না শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কোটি কোটি মানুষ। মহাভারত সাক্ষী, ব্রহ্মাস্ত্রের অধিকার সকলে পান না। যেহেতু Great power comes with great responsibility।