রাজাপক্ষেদের উত্থান শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। কিন্তু এখন আর্থিক সংকট রাতারাতি শ্রীলঙ্কাবাসীকে রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে পথে নামিয়ে দিয়েছে। সে-দেশে রাস্তাঘাটে আলো জ্বালানোর মতো বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
মাত্র কয়েক মাস আগেই শ্রীলঙ্কার (Sri Lanka) সিংহলি যুবতীর ‘মানিকে মাগে হিতে’-র সুরে কোমর দোলাচ্ছিল বিশ্ব। ওটাই ছিল সাম্প্রতিক কালে শ্রীলঙ্কার সেরা বিজ্ঞাপন। শ্রীলঙ্কা মানেই তো আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বিদেশি পর্যটকে ঠাসা সমুদ্রসৈকত, ঝাঁ-চকচকে কলম্বো বা গলের রাস্তায় উদ্দাম নিশি উদ্যাপন, চিনা সংস্থাগুলির ঝলমলে বহুতল ও কালো মসৃণ মেটাল রোডে লম্বা লম্বা বহুমূল্য গাড়ি। কয়েক দিনেই বদলে গেল ছবিটা। রাস্তা-ঘাটে আলো জ্বালানোর মতো বিদ্যুৎ নেই দেশটায়। গৃহস্থের ঘরে রান্না করার গ্যাস নেই। লোকের আলমারিতে প্রচুর টাকা থাকলেও বাজারে মিলছে না পণ্য। বড় বাড়ি ও গাড়ির মালিকও খাদ্যের অভাবে একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
[আরও পড়ুন: ইউক্রেন যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে কারা?]
আচমকা আর্থিক সংকট উচ্ছ্বাস ও উদ্যাপনের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে কীভাবে নেমে এল, তা নিয়ে জোর চর্চা। ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। কীভাবে ব্রিটিশরা এই ছোট দ্বীপরাষ্ট্রটির কৃষি কাঠামোকে বদলে তাকে শুধুমাত্র চা, কফি, রবার ও মশলা উৎপাদনের জন্য উপযোগী করেছিল, সেই কাহিনি বলার প্রয়োজন নেই। ঔপনিবেশিক শাসকরা ইউরোপের বাজারের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে তামিল শ্রমিকদের নিয়ে গিয়ে শ্রীলঙ্কায় বাগিচা চাষের পত্তন ঘটিয়েছিল। স্বাধীনতার পরেও শ্রীলঙ্কা সেই ঔপনিবেশিক আর্থিক জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। আজও দেশটির অর্থনীতি থেকে গিয়েছে মূলত চা, কফি, রবার ইত্যাদি কৃষিপণ্য রপ্তানি নির্ভর। এর সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে বস্ত্র। ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় শপিং মলে এখন দেখা যায় শ্রীলঙ্কার তৈরি জামাকাপড়। চাল, ডাল থেকে শুরু করে অন্য খাদ্যশস্য, গুঁড়ো দুধ, নানা শিল্পজাত পণ্যের জন্য শ্রীলঙ্কাকে নির্ভর করতে হয় আমদানির উপর। বিদেশি মুদ্রা আয়ের বড় সূত্র হিসাবে ইদানীং যুক্ত হয়েছে পর্যটন শিল্প। ইউরোপ ও আমেরিকার পর্যটকরাই এখন শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রা আয়ের মূল ভরসা। যে বিদেশি মুদ্রা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে সঞ্জীবিত রেখেছে।
শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের শুরু খুঁজতে গেলে অবশ্য পিছিয়ে যেতে হবে ছয়ের দশকে। তখনও প্রায় একই ধরনের সংকটের মুখে পড়েছিল দেশটি। আইএমএফের বিরাট ঋণ নিয়ে সে যাত্রায় সংকট কেটেছিল। সাতের দশকে সিরিমাভো বন্দর নায়েকের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্প উন্নয়নের অর্থনীতির নজর কেড়েছিল। শ্রীলঙ্কার বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কর্মসূচির প্রশংসা বারবার অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদের লেখায় তখন দেখা যেত। সামাজিক সুরক্ষা সাধারণ শ্রীলঙ্কাবাসীর জীবনযাত্রার মানের বিপুল উন্নতি ঘটিয়েছিল বলে দাবি করা হয়। বামঘেঁষা বন্দর নায়েকের সরকার পড়ে যাওয়ার পর অবশ্য শ্রীলঙ্কা জে. আর. জয়বর্ধনের হাত ধরে দেখেছিল দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান। যেখানে হাতিয়ার হয়েছিল সিংহলি জাতীয়তাবাদ। যার বিপ্রতীপে তামিল ইলমের দাবি নিয়ে আবির্ভাব হয় প্রভাকরণের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির। ১৯৮৩ থেকে টানা ২০০৯ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ দেখেছে শ্রীলঙ্কা। সে-সময় যাবতীয় সংকটের জন্য তামিল জঙ্গি তথা এলটিটিই-এর সন্ত্রাসকেই দায়ী করে এসেছে দ্বীপরাষ্ট্রটি।
রাজাপক্ষেদের উত্থান শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা। যেখানে সিংহলি জাতীয়তাবাদ তার চূড়ান্ত আধিপত্যের জায়গায় রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংকট রাতারাতি শ্রীলঙ্কাবাসীকে রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে পথে নামিয়ে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকারে শুধু তাঁর নিজের পরিবারের সাত সদস্য। গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে এখন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী। সংকট শুরু হওয়ার পর মাহিন্দার পুত্র নামাল পদত্যাগ করেছেন। তারপরেও রাজাপক্ষদের পরিবারের ছয় সদস্য সরকারে রয়ে গিয়েছেন। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমে শ্রীলঙ্কার এই সংকটের জন্য চিনের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, চিনই ঋণের জালে ফাঁসিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। যদিও শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ১০ শতাংশেরও কম চিনের কাছে। শ্রীলঙ্কা চিনের কাছ থেকে যা ঋণ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ তাদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা জাপানের কাছ থেকে। আইএমএফের ঋণের বোঝাও বিপুল। শ্রীলঙ্কার মানুষ এই সংকটের জন্য দায়ী করছে একেবারেই রাজাপক্ষের সরকারের অদক্ষতাকে। যে অদক্ষতার মূলে রয়েছে নিজের পরিবারের ছ’জনকে মন্ত্রিসভায় বসিয়ে দেওয়ার মতো স্বৈরাচারী মানসিকতা।
২০১৯-এর এপ্রিলে কলম্বোর একাধিক চার্চ ও হোটেলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যাতে মৃত্যুসংখ্যা ২৫০ ছাপিয়ে যায়। এই ধারাবাহিক বিস্ফোরণই একধাক্কায় কলম্বোয় বিদেশি পর্যটক ৭১ শতাংশ কমিয়ে দেয়। ২০১৯ জুড়ে ধারাবাহিকভাবে দ্বীপরাষ্ট্রে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০২০-র অতিমারী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে। ২০১৮-য় শ্রীলঙ্কা যেখানে পর্যটন থেকে ৪৪০ কোটি ডলার আয় করেছিল, ২০১৯-এ সেটা নেমে আসে ৩৬০ কোটি ডলার, ২০২০-তে তা আরও কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬ কোটি ৮২ লক্ষ ডলারে। ২০২১-এ তা কমতে কমতে এসে ৫ কোটি ৩৪ লক্ষ ডলারে দাঁড়িয়েছে। একদিকে বিদেশি মুদ্রার যোগান কমছে, অন্যদিকে ঋণের ভার ও আমদানির খরচ বাড়ার জন্য বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়ছে। তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব সংকট।
২০১৯-এর নভেম্বরে ভোটের আগে গোতাবায়া রাজাপক্ষে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেন ভোটে জিতলে কর কমাবেন এবং কৃষকদের নানারকম ছাড় দেবেন। ভোটে জেতার পর রাজাপক্ষে দেশে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করে দেন। সমস্ত পণ্য পরিষেবার উপর শ্রীলঙ্কা ২ শতাংশ ‘নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স’ গ্রহণ করত। সেটাও তিনি তুলে দেন। শেয়ার বাজারের মূলধনী আয়ের উপর করের হারও কমানো হয়। সবমিলিয়ে রাজাপক্ষর করনীতি ভাঁড়ারে টান ফেলে। অন্যদিকে, বিদেশি মুদ্রার সংকট আমদানিতে প্রভাব ফেলে। কোভিড সংকটে সরকারের খরচও বেড়ে যায়। কোষাগার ঘাটতি জাতীয় উৎপাদনের ১০ শতাংশ ছাড়ায়। আমদানি খরচ কমাতে গিয়ে রাজাপক্ষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দেন। ২০২১-এর তিনি ঘোষণা করেন, দেশের সব চাষ হবে জৈব সার দিয়ে। উন্নত দেশগুলিতে যেখানে চাষযোগ্য জমির মাত্র ৯ শতাংশ জৈব সারের উপর নির্ভরশীল, সেখানে রাজাপক্ষ একমাসের মধ্যে দেশের ১০০ শতাংশ কৃষিযোগ্য জমি জৈব সারের উপর নির্ভরশীল করে দেন। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে গত কৃষি মরশুমের উৎপাদনে। ধান উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যায়। কমে যায় চা-কফি উৎপাদনও। কৃষি উৎপাদনের পতন একদিকে খাদ্য সংকট এবং অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যে সংকট তৈরি করে।
ধান উৎপাদন কমায় শ্রীলঙ্কায় এখন চালের দাম ২২০ টাকা কেজিতে পৌঁছেছে। বিদেশি মুদ্রা সংকটের জন্য সব আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে দেশে পাওয়া যাচ্ছে না গুঁড়ো দুধ, চিনি, নিউজপ্রিন্ট, ডিজেল ইত্যাদি-সহ বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্য। নিউজপ্রিন্টের সংকটে দেশে কাগজ বের হচ্ছে না। প্রশ্ন ছাপা যাচ্ছে না বলে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা বন্ধ। ডিজেল সংকটের প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এতটাই বিদ্যুৎ সংকট যে ‘সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ড’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিনে ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছাঁটাইয়ের। রাস্তায় আলো জ্বলছে না। হাসপাতালে চিকিৎসা করা যাচ্ছে না। চলছে না এটিএম ও মোবাইল ফোন। ফ্রিজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাছ-সহ কোনও পচনশীল খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। মিলছে না রান্নার গ্যাস। ফলে যাদের ঘরে চাল-ডাল আছে, তারাও রান্না করতে পারছে না। সর্বার্থেই ভয়ংকর অবস্থা।
গত কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কায় যারা-ই সরকারে থেকেছে, তারা-ই ভারত ও চিনের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে দু’দেশ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে গোড়ায় ঝুঁকেছিলেন চিনের দিকে। চিনের থেকে আমদানি করা রাসায়নিক সারে ‘এরভিনিয়া’ নামে ব্যাকটেরিয়া মেলার পর থেকে তার সঙ্গে বেজিংয়ের সম্পর্কে কিছুটা অবনতি হয়। ভারত সেই সুযোগ নিতে দ্বিধা করেনি। এই সংকটের সময় ভারত থেকে ডিজেল, চাল-সহ নানা পণ্য যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। তবে সংকটের জন্য সেদেশের মানুষের মুখে এখন একটাই স্লোগান- ‘গো হোম গোতা’। নিজের গুষ্টিকে মন্ত্রী বানিয়ে ও দেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে এবং আচমকা কর কমানো ও জৈব চাষ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনিই এই সংকট তৈরি করেছেন বলে দাবি সিংহলিদেরই। যাদের ‘পোস্টার বয়’ এতদিন তিনিই ছিলেন। ‘আরব বসন্ত’-র মতো শ্রীলঙ্কা এই বসন্তে কোনও বিপ্লব দেখবে কি না, তা এখন সময়ই বলবে।