shono
Advertisement

ব্যক্তিগত আক্রোশ না গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত, কেন খুন হলেন শিনজো আবে?

জাপানের মতো শান্তিপূর্ণ দেশে এমন রাজনৈতিক হত্যা সকলকে চমকে দিয়েছে।
Posted: 01:42 PM Jul 09, 2022Updated: 01:42 PM Jul 09, 2022

গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হল জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস, বন্দুক ব্যবহারের বিরুদ্ধেই বেশ কড়া নিয়ম জারি করেছিলেন শিনজো আবে। রাজনৈতিক হত্যায় ব্যক্তিগত আক্রোশ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে মত, ভাবাবেগ ও আদর্শ। লিখেছেন শুভময় মৈত্র

Advertisement

তেতসুয়া ইয়ামাগামি। জনৈক জাপানি নাগরিক। বয়স ৪১। তার নাকি জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের (Shinzo Abe) কাজকর্ম ভাল লাগত না। অতএব, জাপানের (Japan) নারা অঞ্চলে, কাশিহারা শহরে, তাঁকে গুলি করে হত্যা করল তেতসুয়া। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা হিসাবে ৬৭ বছর জাপানের হিসাবে মোটেও বেশি বয়স নয়। বলা ভাল, সারা বিশ্বেই এখন দেশনেতাদের অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত কাজ করতে দেখা যায়। অর্থাৎ, সোজা কথায় আগামী অনেকগুলো বছর রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকার সুযোগ ছিল শিনজো মহাশয়ের।

শিনজো আবে ছিলেন ‘লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’-র নেতা। সংবাদমাধ্যমে খবর, গুলি লাগে তাঁর ঘাড়ে এবং বুকে। আরও খবর যে, বৃহস্পতিবার রাতেই নাকি ঠিক হয় তাঁর এই কর্মসূচি। এই রবিবার সেখানে সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন। অর্থাৎ, সেভাবে ভাবলে বেশ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আততায়ী। এমনও শোনা যাচ্ছে, শিনজো আবেকে হত্যা করার পর মোটেও পালানোর চেষ্টা করেনি তেতসুয়া। ধরা পড়ে জানিয়েছে, তার নাকি শিনজো আবে-র রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর কোনও বিরাগ নেই, বরং রাগ মানুষটির মতাদর্শে। উল্লেখযোগ্য, ‘মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্স’-এর হয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর কাজ করেছে তেতসুয়া। অর্থাৎ, যদি অস্ত্র হাতে কাজ করে থাকে, তাহলে এখন থেকে ১৭ বছর আগে সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছে যখন তার বয়স ছিল ২৪।

[আরও পড়ুন: সংসদে বাংলার প্রতিনিধি আনার তোড়জোড় শুরু বিজেপির, ঠাঁই হতে পারে দু’জনের]

আরও এক আগুনপথে হাঁটা অবিমৃশ্যকারীর আগ্নেয়াস্ত্রে জীবনাবসান হল এক দেশনেতার। আততায়ীর সম্পর্কে এত শব্দ খরচের কারণ এই যে, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যাদের হাত থাকে, অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টাকে সাদামাটা খুন হিসাবে কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ না করে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বাকি বিশ্লেষণের স্থান সংকুলানে পাঠক-পাঠিকাদের মগজাস্ত্রই ভরসা।

তবে এইটুকু পড়ে, এবং বিশেষ করে ‘লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’র নাম শুনে, কেউ যদি ভেবে বসেন শিনজো আবে উদারবাদী এবং বামদিকে ঘেঁষে থাকা নেতা ছিলেন, বাস্তবে তা একেবারেই নয়। বরং তাঁর রাজনীতির অনেকটা অংশই ছিল দক্ষিণপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী। বিদেশে সৈন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জাপানের সবথেকে বেশি সময় রাজত্ব করা প্রধানমন্ত্রী তিনি। তাঁর পরিবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পিতামহ ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী, পিতা দেশের বিদেশমন্ত্রী। অর্থাৎ, জাপানের কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত পরিচিত মুখ আবে। জাপানের অর্থনৈতিক সংস্কারেও তাঁর নীতি আলোচিত হয়েছে বারবার, যেখানে রাজনীতির অন্যান্য বিষয়ের মতোই পক্ষে এবং বিপক্ষে প্রচুর যুক্তি। সবথেকে বড় কথা, বিশ্ব রাজনীতিতেও তাঁর উপস্থিতি যথেষ্ট আলোচিত। গত বছর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’-এ ভূষিত হন তিনি। ভারত সরকারের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। ২০০৭ সালে তাঁর বিশেষ উদ্যোগেই চার দেশের ‘কোয়াড’ গঠিত হয়, যার সদস্য হল: জাপান, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিরিখে ৮ জুলাই, ২০২২ দিনটি আমাদের দেশবাসীর পক্ষে শোকের। স্বভাবতই অর্ধনমিত হল ভারতের জাতীয় পতাকা।

[আরও পড়ুন: ক্যানিংয়ে ৩ তৃণমূল নেতা-কর্মী খুনে প্রথম গ্রেপ্তার, কুলতলি থেকে পাকড়াও আফতাবউদ্দিন]

শীর্ষ রাষ্ট্রনায়ক এবং বিশ্ববরেণ্য রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে ‘বিরল’ নয়। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিশেষ ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যাক। আমাদের দেশের নিরিখে মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীর কথা আলোচিত হয় বারবার। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে রোমান সেনেটরদের ষড়যন্ত্রে জুলিয়াস সিজারের হত্যাকাণ্ড অতীত ইতিহাসের মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা বামপন্থী নেতাদের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্যাট্রিস লুমুম্বা এবং চে গুয়েভারা-র কথা আসবে। এর ঠিক উলটোদিকেই থাকবে বলশেভিকদের উত্থানে রাশিয়ায় জার দ্বিতীয় নিকোলাসের হত্যাকাণ্ড। কেনেডি-হত্যার ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যের কথা উঠে আসবে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি পার্ক চুং হি আবার সতীর্থদের হাতে নিহত হন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায়। আমাদের দেশের কাছেই ‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবুর রহমান এবং বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুর নেপথ্যে সামরিক বাহিনীর চক্রান্তের কথা উঠে আসে। চিলিতে সালভাদোর আলেন্দে-কেও হত্যা করে সে-দেশের সেনাবাহিনী। তবে এখনকার অশান্ত বিশ্বের তুলনায় জাপান যে ধরনের শান্তিপূর্ণ দেশ– সেখানে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অবশ্যই তুলনায় আসবে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ওল্‌ফ পালমের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা।

বন্দুক ব্যবহারের বিরুদ্ধে বেশ কড়া নিয়ম জারি করেছিলেন শিনজো আবে। কিন্তু সেই বন্দুকের গুলিতেই প্রাণ গেল তাঁর। আগামীর ইতিহাস বলবে সত্যিই এই মৃত্যু তেতসুয়া ইয়ামাগামির ব্যক্তিগত আক্রোশে, না কি এর নেপথ্যে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত। রবিবারের নির্বাচন যদি বাতিল না হয়, সেক্ষেত্রে ভোটফলে এর প্রভাব কতটা পড়ে সেটাও দেখার।

(মতামত ব্যক্তিগত)
লেখক আইএসআই কলকাতার অধ্যাপক

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement