shono
Advertisement

চাকরি পেলেন ও খোয়ালেন সাংবাদিক নিধি রাজদান

নিধি নিজেই জানিয়েছেন কীভাবে এক পরিকল্পিত প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি।
Posted: 03:05 PM Jan 21, 2021Updated: 03:05 PM Jan 21, 2021

অতনু বিশ্বাস: ক’দিন আগে এক প্রাক্তন ছাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছেন গুজরাটের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর চাকরির আবেদন, ইন্টারভিউ, যোগদান, প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা ও সহকর্মীর সঙ্গে আলাপচারিতা– সবকিছু হয়েছে আন্তর্জালের মাধ্যমে। পুরোটাই তিনি করেছেন কলকাতায় বসে। শিগগির ক্লাস শুরু হবে, সে-ও অনলাইনে। কোভিডের আগেই দুনিয়া আন্তর্জালে বাঁধা পড়েছিল অনেকখানি। অতিমারীর প্রকোপ সেই ডিজিটাল নাগপাশ পোক্ত করেছে মাত্র। তা, এক সন্ধেয় আমরা কয়েকজন, তার নতুন চাকরি উদ্‌যাপন করতে গিয়েছি পিৎজা খেতে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: হার-জিত অন্য বিষয়, এই ভারতীয় দল নিয়ে আলোচনা হবে ভবিষ্যতেও]

ঘটনাচক্রে সেদিনই জানলাম নিধি রাজদান-কে নিয়ে ‘ফিশিং’-এর ঘটনাটা। জুন মাসে এনডিটিভি-র ২১ বছরের চাকরি ছেড়েছিলেন এই সাংবাদিক হার্ভার্ডে সাংবাদিকতা পড়াতে যাওয়ার জন্য। প্রায় দু’-দশক ধরে আমার মতো বহু মানুষের প্রিয় এক টেলিভিশন অ্যাঙ্কার নিধি রাজদান। তাঁর অ্যাঙ্কারিংয়ের জাদুতে বাম, ডান আর মধ্যপন্থার চিরন্তন দ্বন্দ্বের মাঝে আমরা আবর্তিত হয়েছি দীর্ঘদিন। স্বাভাবিক, তাঁর হার্ভার্ডে পড়াতে যাওয়ার খবরে টিভির পর্দায় এক প্রিয় সাংবাদিককে ‘মিস’ করার কথা মনে হচ্ছিল সে সময়।

কিন্তু ক’দিন আগে নিধি রাজদান (Nidhi Razdan) নিজেই জানিয়েছেন কীভাবে এক পরিকল্পিত প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। প্রতারকরা তাঁকে হার্ভার্ডে চাকরির আবেদন করতে বলেছে, ধাপে ধাপে তাঁর আবেদন ‘প্রসেস’ করার ভান করেছে, অনলাইনে তাঁর ইন্টারভিউ নিয়েছে, তাঁকে চাকরির ‘অফার’ দিয়েছে, তাঁর ব্যাংক এবং ব্যক্তিগত তথ্যাদি নিয়েছে ভিসা এবং মাইনে দেওয়ার নাম করে, তাঁকে পড়ানোর বিষয় এবং সূচি পাঠিয়েছে। এসব চলেছে দীর্ঘদিন। শেষে মাইনের টাকা জমা না পড়ায় তিনি খোঁজ নেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জানতে পারেন তাঁকে ‘ভুয়ো’ চাকরি দেওয়া হয়েছে। সে-চাকরির সঙ্গে ওই ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। যাকে বলে ‘ফিশিং’। পুরোটাই করেছে কোনও অজ্ঞাত প্রতারক বা প্রতারকের দল। এসবের পিছনে বড়সড় পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে অবশ্যই। মাঝে অনেক কিছু হয়নি সময়মতো। যেমন ওরিয়েন্টেশন, ক্লাস শুরু হওয়া। প্রতারকরা দোহাই দিয়েছে কোভিড অতিমারীর। নিধি রাজদানও সন্দেহ করেননি একই কারণে। অতিমারী তো দুনিয়াটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে সত্যিই!

‘ফিশিং’ হল এমন প্রকরণ যেক্ষেত্রে শিকার নিজেই সংবেদনশীল এবং গোপনীয় তথ্য বা টাকাপয়সা দিয়ে ফেলে। আসলে, তাদের ধারণা হয় যে, এটা না-করলে তার সমূহ ক্ষতি হবে। ভণ্ড মানুষদের ছদ্ম মহিমায় আবিষ্ট হয়ে টাকাপয়সা, ধনসম্পত্তি এবং আরও অনেক কিছু স্বেচ্ছায় দিয়ে দেওয়ার ঘটনা তো ঘটে আসছে স্মরণাতীত কাল থেকে। ডিজিটাল জগতের চৌহদ্দিতে ‘ফিশিং’-এর ইতিহাস অবশ্য মোটামুটি বছর পঁচিশের। ‘ফিশিং’ হয় নানাভাবে। কখনও ব্যাঙ্ক অথবা এটিএমের পাসওয়ার্ড জানতে। কখনও কোনও পরিচিত মানুষের নাম করে ইমেল আসে, তিনি বিপদে পড়েছেন, সঙ্গে থাকে টাকা পাঠানোর অনুরোধ। ২০১৩-য় র‍্যানসামওয়্যার দখল নেয় পৃথিবীজুড়ে প্রায় আড়াই লক্ষ কম্পিউটারে। টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব আসে। এ-ও এক ধরনের ‘ফিশিং’। সময়ের সঙ্গে মানুষ ক্রমে বুঝতে পারে এসবের চালচিত্র। খানিক সচেতনতা আসে। সময়ের সঙ্গে অবশ্য ‘ফিশিং’-এর চরিত্রও বদলেছে, এসেছে নতুন এবং অত্যাধুনিক চমক, প্রযুক্তির ছোঁয়া। বছরখানেক ধরে যেমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে কোভিড অতিমারী সম্পর্কিত ‘ফিশিং’ ইমেলগুলি। সেখানে টাকার প্রলোভন, চিকিৎসা-সংক্রান্ত নিয়ামক সংস্থার নকল সতর্কবাণী, বাড়ি থেকে কাজ করার প্রস্তাবনা, নেটফ্লিক্স কেলেঙ্কারি, কোয়ারান্টাইন ভাঙলে জরিমানা এবং আরও অনেক কিছু।

নিধি রাজদানের মতো এক সাংবাদিক কীভাবে ‘ফিশিং’-এর শিকার হলেন, সে নিয়ে অনেকেই বিস্মিত! কিন্তু এই ‘ফিশিং’-এর পর্বে কেউ কখনও তাঁর কাছে টাকাপয়সা চায়নি, ফলে সন্দেহ হওয়ার অবকাশ ছিল কম। অনেকে অবশ্য কিছুটা দায়ভার চাপাচ্ছেন নিধি রাজদানের উপরেই। তাঁর পিএইচডি না থাকা সত্ত্বেও হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে তাঁকে অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর পদে নিযুক্ত করতে পারে এবং সে নিয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান হননি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এটাও ঠিক যে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই বলা থাকে যে, চাকরিতে প্রয়োজনে ‘ব্যতিক্রমী’ প্রার্থীদের ছাড় দেওয়া যেতে পারে বয়স বা শিক্ষাগত যোগ্যতায়।

নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ জর্জ অ্যাকেরলফ আর রবার্ট শিলারের ২০১৫-র বই ‘ফিশিং ফর ফুল্‌স’। এ যেন কারসাজি সম্পর্কিত অর্থনীতির ভাষ্য! কীভাবে কারসাজি আর প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রেতারা নিয়মিতভাবে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা এবং অজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লাভের কড়ি খোঁজে। ‘ফিশিং’-এর মাধ্যমে ‘ফুল্‌স’ ধরার মানসিকতা তাই ডিজিটাল মাধ্যমের আবর্তে আটকে নেই। সমাজের মজ্জায় মজ্জায় বাজতে থাকে এর অনুরণন। কম-বেশি আমরা অনেকেই কিন্তু এই ‘ফুল্‌স‌’-এর দলে।

‘আই অ্যাম নিধি রাজদান, নট আ হার্ভার্ড প্রোফেসর, বাট…’ শীর্ষক আর্টিকলে নিধি রাজদান লিখছেন, ‘আমার এবং আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা শিক্ষা রয়েছে– অনলাইনে কোনও কিছুর উপর কখনওই বিশ্বাস করবেন না।’ এর সঙ্গে অবশ্য আমি একমত নই। আরও এবং আরও সতর্কতা আমাদের শিক্ষা। ‘ফিশিং’-এর ফাঁদ থেকে হয়তো মুক্তি নেই সভ্যতার, কিন্তু আন্তর্জালের আওতার বাইরে গিয়েও চলার বড় একটা উপায়ও বোধহয় নেই দুনিয়ার। ‘কোভিড ১৯’ আমাদের দুনিয়াকে সংবেশিত করেছে এক বিমূর্ত ডিজিটাল অস্তিত্বে। সদ্য গুজরাতের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া আমাদের সেই ছাত্রটির মতোই আমার পরিচিত আরও অনেকে এই অতিমারীর বছরে চাকরি পেয়েছেন নানা জায়গায়, যোগ দিয়েছেন, যার পুরোটাই আন্তর্জালের মাধ্যমে। একজন যেমন নামজাদা গাড়ি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। পুরোটাই চেন্নাইয়ের বাড়িতে বসে, আন্তর্জালের মাধ্যমে। সুতরাং এই বিমূর্ত অস্তিত্বের পুরোটাই ভঙ্গুর বুদ্বুদ, তা হয়তো নয়।

নামজাদা অভিনেতা, খেলোয়াড়, বিজ্ঞানী-সহ দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় মানুষ ‘ফিশিং’-এর শিকার। যেমন, বছরখানেক আগে ‘ফিশিং’-এর শিকার হয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজেতা এবং ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর কলমচি পল ক্রুগম্যান। সদ্যসমাপ্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারপর্বও তো ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ‘ফিশিং’-এর দাপটে। নানাভাবে। স্বাভাবিক কারণেই নিধি রাজদান ‘রাগান্বিত, হতাশ এবং বিপর্যস্ত’। আশা রাখি, এক স্বল্পকালীন অনভিপ্রেত বিরতির পরে সাংবাদিকতার নতুন ইনিংসে আবার তাঁকে আমরা ফিরে পাব নতুন উদ্যমে। বাম, দক্ষিণ আর মধ্যপন্থার তুল্যমূল্য সঞ্চালনে।

(মতামত নিজস্ব)

লেখক কলকাতা আইএসআই-এর অধ্যাপক
appubabale@gmail.com

[আরও পড়ুন: একুশের অঙ্ক: বিধানসভা ভোটে এবার বাংলায় লড়াই সরাসরি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement