shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: গোটা বিশ্বকে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পথ দেখাচ্ছে ইজরায়েল

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছেন।
Posted: 02:15 PM Mar 31, 2023Updated: 02:16 PM Mar 31, 2023

বিশ্বজুড়ে একনায়কদের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছেন। সম্প্রতি ইজরায়েলের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সরব সেখানকার মানুষ। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় শাসক দলের সঙ্গে ইজরায়েলি সরকারের কর্মপদ্ধতির মিল কেউ খুঁজে পেলে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। লিখলেন সুমন সেনগুপ্ত

Advertisement

ইজরায়েল ফুঁসছে। ইজরায়েলের মানুষরা লাখে-লাখে রাস্তায় নেমেছেন। ছাত্র, শ্রমিক, কর্মচারী থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। ইজরায়েলের (Israel) প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু (Benjamin Netanyahu) চাইছেন, সেই দেশের বিচারব্যবস্থা করায়ত্ত করতে। কিছুদিন আগে, তঁারই মন্ত্রিসভার এক সদস্য বলেছিলেন, এই বিচারব্যবস্থার পরিবর্তনে হয়তো সামরিক বাহিনীর মধ্যে অসুবিধা তৈরি হতে পারে। সেই সদস্যকে নেতানিয়াহু বহিষ্কার করার পর মানুষজন আরও বেশি মাত্রায় রাস্তায় নামতে শুরু করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পঠনপাঠন বন্ধ হয়েছে। আর শ্রমিকরা বলছেন, এবার তঁারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করবেন। ইজরায়েলে যঁারা বিদেশি লগ্নিকারী, তঁারা অবধি এই মুহূর্তে দ্বিধাগ্রস্ত ও-দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে! অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইজরায়েলের রাজধানী তেল আভিভের মূল বিমানবন্দর বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, কারণ শ্রমিক সংগঠনের নির্দেশে অচল হয়ে গিয়েছে তা।

[আরও পড়ুন: দিল্লির ডাগআউটে থাকবেন ঋষভ পন্থ! তারকার জন্য তৈরি হচ্ছে স্পেশ্যাল র‌্যাম্প]

বিক্ষোভকারীরা বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে তেল আভিভের রাস্তায় আছেন। তঁাদের অনেকের হাতেই পোস্টার, ব্যানার। লেখা– ‘কোনও মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে নন’। কেউ কেউ আবার চাইছেন– নেতানিয়াহু, ট্রাম্প এবং পুতিনের গ্রেপ্তারি। যা খবর পাওয়া যাচ্ছে– জেরুজালেমে নেতানিয়াহু-র বাড়ির সামনেও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মানুষ।

এবার বোঝা দরকার, কেন ইজরায়েলের মানুষ এত বিক্ষুব্ধ! নেতানিয়াহুর দল এযাবৎ সময়ের চরম দক্ষিণপন্থী দল, যঁাদের অন্যতম অস্ত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উৎপীড়ন। নেতানিয়াহু-র বক্তব্য অনুযায়ী– তঁাদের চলমান বিচারব্যবস্থা নাকি সেদেশের বৈচিত্রকে ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারছে না, ইজরায়েলি সমাজের বৈচিত্র সেদেশের সর্বোচ্চ আদালতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সেজন্য তিনি বিচারপতি নিয়োগ করার যে ৯ সদস্যের কমিটি, সেই কমিটিতে রদবদলের প্রস্তাব দেন। বলা হয়, এরপর থেকে এই বিচারপতি নিয়োগের কমিটির সদস্য নির্বাচন করবে সরকার। আরও বলা হয়, কিছু আইনের জোরে, সে-দেশের বিচারপতিরা এখন যেভাবে বেশ কিছু সরকারি প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে নাকচ করে দিচ্ছেন, সেই আইনগুলোও বদলানো জরুরি। অনেকে বলছেন, এই বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন করতে পারলে, ওই দেশে সরকারের হাতে আরও ক্ষমতা চলে আসবে। দেশের নাগরিকদের জন্য, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মানুষদের জন্য এখনও যে রক্ষাকবচ আছে, তা তুলে নেওয়া হবে– ফলে সেই দেশে ধর্মীয় হানাহানি আরও বাড়বে। অনেকের আশঙ্কা এ-ও যে, নেতানিয়াহুর উপর যে-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, এই বিচারব্যবস্থা বদলের পরে, সেই অভিযোগের হাত থেকে নিজেকে তিনি বঁাচানোর চেষ্টা করবেন।

[আরও পড়ুন: ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন অসাংবিধানিক’, বাকস্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়ে ঘোষণা লাহোর হাই কোর্টের]

মূলত সামরিক বাহিনীর মধ্য থেকে বেশি প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে। তঁাদের বক্তব্য, যদি বিচারব্যবস্থা নেতানিয়াহু-র করায়ত্ত হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের সামরিক বাহিনীকে এমন কিছু নির্দেশ দেওয়া হতে পারে, যা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারে। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়াভ গ্যালান্ট, যেহেতু এই সামরিক বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ-সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলেছেন, তাই তঁাকে বরখাস্ত করেন নেতানিয়াহু। কথা ছিল, খুব দ্রুত সেখানকার সংসদে এই বিষয় নিয়ে ভোটাভুটি হবে। কিন্তু প্রতিবাদ-আন্দোলন এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যে, আদৌ এই বিচারব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা হবে কি না, তা নিয়েই এখন সেখানকার শাসক দল সংশয়ে।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইউভাল নোয়া হারারি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উদ্দেশে বলেছেন, বহু বছর আগের মিশরের ফারাওদের কথাও মানুষ মনে রেখেছেন, কিন্তু এই প্রধানমন্ত্রী– যিনি তঁার দেশের মানুষকেই ক্রীতদাস বানাতে সচেষ্ট– তঁার কথা কি কোনও মানুষ মনে রাখবেন? রাস্তা, চৌমাথা বা বিমানবন্দরও কিন্তু তঁার নামাঙ্কিত থাকবে না। তিনি আরও বলেছেন, দেশের সামরিক বাহিনীর উচিত নেতানিয়াহু-র পরিবর্তে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পালন করা। মেরুদণ্ডহীন মানুষের মতো যদি তঁারা অন্ধভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করেন, তাহলে ভবিষ্যৎ ভয়ংকর হতে পারে। আরও একজন পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিখমা ব্রেসলার, যিনি এই আন্দোলন থেকে গ্রেফতার হয়েছেন, একটি সমাবেশে বক্তব্য রাখাকালীন বলেন– বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র এই পদক্ষেপ আসলে স্বৈরতন্ত্রের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। যা বোঝা যাচ্ছে, এই আন্দোলন কিন্তু সহজে থামবে না।

হয়তো খেয়াল আছে, তা-ও স্মরণ করিয়ে দিই, এই নেতানিয়াহু-র ইজরায়েলের কাছ থেকেই কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার ‘পেগাসাস’ নামের একটি সফটওয়‌্যার কিনেছিল বলে অভিযোগ, যার সাহায্যে দেশের বিরোধী দলনেতা, এমনকী, বিভিন্ন সাংবাদিকের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে, সরকারের তরফে, যদিও বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। কিন্তু বিরোধীরা এখনও সরব হলে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিপদে পড়বে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?

কেউ যদি ইজরায়েলের এই দৃষ্টান্তগুলোর সঙ্গে এ-দেশের চলমান শাসক দলের কর্মপদ্ধতির কিছু মিল পান, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশের আইনমন্ত্রীও কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নির্বাচনের বিরোধিতা করছেন। তিনিও চাইছেন, এই কলেজিয়ামে সরকারের প্রতিনিধি থাকুক। তবে এখনও অবধি আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি সরকারি এই দাবির সামনে নত হননি।

বিশ্বজুড়ে এই ধরনের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছেন। কোথাও ট্রাম্প, কোথাও বলসোনারো, কোথাও নেতানিয়াহু– চরমপন্থী শাসকরা মানুষের রোষের শিকার হচ্ছেন। পরিস্থিতি দেখে ইতিহাসের পাতা থেকে পুরনো দৃষ্টান্ত উঠে আসছে। মানুষের যদি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তাহলে তঁারা শাসককে পরাজিত করার ক্ষমতা রাখেন। মানুষের সহ্যের সীমা অবধিই কিন্তু একজন শাসক তঁার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালিয়ে যেতে পারেন। তারপর তঁাকে রণে ভঙ্গ দিতেই হয়। শাসকতোষী গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও বুঝি-বা সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement