shono
Advertisement

২৪-এ হ্যাটট্রিক করতে না পারলে নেহরুকে ছোঁবেন কী করে মোদি?

এতদিন অচ্ছুৎ রাখা দলগুলিকে ফের বাবা-বাছা করে কাছে টানছে বিজেপি।
Posted: 06:35 PM Jul 13, 2023Updated: 06:37 PM Jul 13, 2023

২০২৪-এ হ্যাটট্রিক নিশ্চিত করতে মরিয়া বিজেপি পুরনো জোট চাঙ্গা করতে কোমর বেঁধেছে। অথচ ’১৯-এর ভোটের পর, শরিকদের ‘নাম-কে-ওয়াস্তে’ মন্ত্রিত্ব দেওয়া ছাড়া কোনও দাবিতে কর্ণপাত করেনি তারা। নির্দ্বিধায় জানিয়েছিল, না পোষালে দরজা খোলা। উলটপুরাণের কারণ কী? কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

বাঘের আগে ফেউ ডাকে। ফেউ হল শিয়াল। তার ডাক সতর্ক-সাইরেন। সাবধান, ধারেকাছে বাঘ ঘোরাঘুরি করছে। এই বাংলা বাগ্‌ধারাটি মনে পড়ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রকমসকম দেখে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সপ্তমে স্বর তুলছেন, অথচ দেখা যাচ্ছে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’-রা বিজেপিতেই যোগ দিচ্ছে! আমেরিকা থেকে ফিরেই তুলোধোনা করলেন শরদ পাওয়ারের দল এনসিপি-কে। বললেন, ওরা ৭০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। কী আশ্চর্য, তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা গেল, সেই দলের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’-রা তাঁর সঙ্গী! এমন একজন মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হলেন, যাঁর বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট চার্জশিট পর্যন্ত দাখিল করেছে!

ভোট দামামার দ্রিমিদ্রিমি ধ্বনির মধ্যে তেলেঙ্গানায় গিয়েও প্রধানমন্ত্রী সেই রাজ্যের শাসক দল বিআরএস-এর দুর্নীতির ঢাক জোরসে পিটিয়েছেন। সন্দেহ জাগছে, শরদ পাওয়ারের মতো চন্দ্রশেখর রাওয়ের ঘরও বোধহয় ভাঙতে চলেছে। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি যেন সিনেমার খলচরিত্র! টিকে থাকার একটাই মন্ত্র- অন্যর সংসার ভাঙা। ঘর ভাঙিয়ে বিপক্ষকে দুর্বল করতে না পারলে শুধু রাজ্য দখল নয়, ২০২৪ সালে হ্যাটট্রিকও যে কঠিন- বিজেপির এই আচরণ তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে শিব সেনা ও তারপর এনসিপি ভাঙিয়ে মহারাষ্ট্রকে ‘নিরাপদ’ করার পর এবার তাদের নজর নিবদ্ধ বিহারে। অতি দ্রুত সেখানে তারা নীতীশ কুমারের সংসার ভাঙতে চাইছে। নইলে আশঙ্কা, বিনিদ্র রজনীযাপন তাদের নিশ্চিত ললাটলিখন হয়ে দাঁড়াবে। সুশীল মোদি ও সঞ্জয় জয়সওয়ালের মতো বিহারের বিজেপির নেতা তা বুঝিয়েও দিচ্ছেন। দু’ভাবে সেই চেষ্টা চলছে। প্রথম লক্ষ্য জেডি (ইউ) ভাঙানো। দ্বিতীয় চেষ্টা আরজেডি-কে নড়বড়ে করে তোলা। সেজন্য তেজস্বী যাদবকে ব্যতিব্যস্ত করার পুরনো খেলা নতুন করে শুরু হয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকার চেয়েও মোদির বড় চিন্তা নিজেকে নিয়ে। ২০২৪-এ হ্যাটট্রিক করতে না পারলে জওহরলাল নেহরুকে ছোঁবেন কী করে?

কীভাবে তা তারা করবে, সেই ছক অনুমান করা আজ আর বিশেষ কষ্টকর নয়। ইডি, সিবিআই বা এই জাতীয় খেলা যে রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার, তা জলের মতো স্বচ্ছ ও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কে, কবে, কী করেছে, কার বিরুদ্ধে কোন কালে কোন অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, সেসব টেনে বের করে বিরোধীদের ভয় দেখানোর খেলা অনেক দিন আগেই শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে চলছে ‘তুই না করলেও তোর বাপ জলঘোলা করেছিল’ গোছের অভিযোগ। পান থেকে চুন খসেছে কি খসেনি, হয় এফআইআর দায়ের হচ্ছে, নয়তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ঠোকা হচ্ছে মানহানির মামলা। সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, রাস্তা দুটো- হয় সঙ্গী হও, নিরুপদ্রবে থাকো, নয় জেলে যাও। ‘চাক্কি পিসিং’-এর ভয় যত জাঁকিয়ে বসছে, তত বাড়ছে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা। মহারাষ্ট্র তার সর্বশেষ নমুনা।

পশ্চিমবঙ্গর বামফ্রন্ট সম্পর্কে বলা হত, ভোট কারচুপি তথা ‘রিগিং’-কে তারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে ক্ষমতাসীন থাকার বিষয়টিকে বিজেপিও সেই পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

এতে ভবিষ্যতে কী হবে পরের কথা, তবে প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিজেকে বিরাট প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর দলকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ কিংবা গঙ্গার সঙ্গে তুলনা করাটা যে মোটেই বাড়াবাড়ি নয়, বারবার তা প্রমাণিত। এ-ও বোঝা যাচ্ছে, তাঁরই দলনেতা প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছিলেন (প্রধানমন্ত্রী মোটেই দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন না, দুর্নীতিগ্রস্তরা তাঁরই অফিস ব্যবহার করে), সেই অভিযোগ অসত্য নয়। সত্যিই তো, যাঁদের বিরুদ্ধে ৭০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ, তাঁরা সদলে সঙ্গী হলে কী প্রমাণ হয়? সত্যপাল মালিক মিথ্যেবাদী?

বিজেপি এতটা বেপরোয়া অনেকগুলো কারণে। তৃতীয়বার জিততে গেলে দ্বিতীয়বারের মতো অথবা তার কাছাকাছি আসন তাদের পেতেই হবে। হালের অবস্থায়, তা কঠিন। তারাও বুঝেছে ‘মোদি ম্যাজিক’ আগের মতো মোহাবিষ্ট করতে পারছে না। কর্নাটক হারানোর পর শঙ্কা আরও জঁাকিয়ে বসেছে। তিনটি রাজ্য তাদের দুশ্চিন্তার বড় কারণ। কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও বিহার। তিন রাজ্যের মোট ১১৬টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি গতবার জিতেছিল ১০৬টি। কর্নাটকে ২৮-এর মধ্যে ২৬, মহারাষ্ট্রে ৪৮-এর মধ্যে ৪১ ও বিহারে ৪০-এর মধ্যে ৩৯।

পাঁচ বছর আগে মোদির ভাবমূর্তি যা ছিল, আজ তেমন অমলিন নয়। জৌলুস কমেছে। অসন্তোষ বেড়েছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিরোধীরা জোটবদ্ধতার তাগিদ অনুভব করেছে। জোট পাটিগণিত ও ভোট রসায়ন যা, তাতে গা-ঝাড়া না দিলে শুধু এই তিন রাজ্য থেকেই বিজেপির আসন অর্ধেক কমে যেতে পারে। মহারাষ্ট্রে এনসিপি ভাঙা ও বিহারে নীতীশ-তেজস্বীকে দুর্বল করার তাগিদ তাই এতখানি। তাতে আদর্শ, নীতি কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে নির্ঘোষ চুলোয় গেলে যাক। আগে ক্ষমতা দখল, তারপর বাকি সব।

[আরও পড়ুন: হার্ভার্ড-কাঁটা, ভরতির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বেশি পাচ্ছেন শ্বেতাঙ্গরা!]

কিন্তু শুধু এই তিন রাজ্য জয় হ্যাটট্রিকের ছাড়পত্র হতে পারে না। গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাড়তি আসন পাওয়ার মতো কোনও উপায় বিজেপি নিজেই রাখেনি। বরং কমার সম্ভাবনা বেশি। তা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করা বিজেপির এই মুহূর্তের ইতিকর্তব্য। সেজন্যই এতদিন অচ্ছুৎ রাখা দলগুলিকে ফের বাবা-বাছা করে কাছে টানছে। এনডিএ জোটের নামাবলি আরও একবার গায়ে জড়িয়েছে। কর্নাটকে ‘দুর্নীতিবাজ’ দেবগৌড়াদের পারিবারিক দল জেডি(এস)-এর দিকে বন্ধুতার হাত বাড়িয়েছে। দু’হাত দু’পাশে সরিয়ে আবাহন করছে উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির শরিক ওমপ্রকাশ রাজভরের দল সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি, নিষাদ পার্টি ও জাট নেতা জয়ন্ত চৌধুরীর দল আরএলডিকে।
বিহারের হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চাকে কাছে টানার পর নজর দিয়েছে চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টির দিকে। হরিয়ানায় শরিক দুষ্মন্ত চৌটালার জেজেপির সঙ্গে আদায়-কাঁচকলা সম্পর্ক আমে-দুধে পরিণত করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। অকালি দলকে পাশে না টানলে পাঞ্জাবে একটি আসনও জুটবে না বুঝে নতুন করে সমঝোতার হাত বাড়িয়েছে। চিরাগ পাসোয়ান ও বাদল পরিবারকে মন্ত্রিসভায় ঠঁাই দেওয়ার চর্চা তুঙ্গে। অকালি দলের মতোই পুরনো শরিক তেলুগু দেশম। চন্দ্রবাবু নাইডুর কদর তাই বেড়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডি ‘আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত’ হলেও তাঁর জন্য দরজা খুলে রেখেছে।

২০১৯-এর ভোটের পর, শরিকদের দিকে বিজেপি ভুলেও তাকায়নি। ‘নাম-কে-ওয়াস্তে’ মন্ত্রিত্ব দেওয়া ছাড়া কোনও দাবিতে কর্ণপাত করেনি। নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিয়েছে, না পোষালে দরজা খোলা। একে-একে শরিকদের নিষ্ক্রমণ সত্ত্বেও তারা বিচলিত হয়নি। সেই বিজেপি আজ পুরনো জোট চাঙ্গা করতে কোমর বেঁধেছে। ফাঁদে পড়লে বগার (বক) ছটফটানি এমনই হয়।

ঘর ভাঙা ও ঘর গড়ার খেলা প্রাক্‌-নির্বাচনী আবহে এই সময়ের সেরা আকর্ষণ। কিন্তু সেই তোড়জোড় বিজেপিতে সংশয় ও অশান্তিরও জন্ম দিচ্ছে। যেমন মহারাষ্ট্র। বিজেপি বিধায়করা ভেবে পাচ্ছেন না শিন্ডে-সেনা ও অজিত পাওয়ার গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে তঁাদের কতটা কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। এনসিপি-র আগমনে শিন্ডে সৈনিকরাও দিশাহারা। তারা ভাবছে, উদ্ধবের ঘর ভেঙে বেরিয়ে আসা হারাকিরি হল কি না। সবচেয়ে বড় কথা, নরেন্দ্র মোদিকে কেন বিশ্বাস করব- সেই প্রশ্ন সাধারণের মনে চাগাড় দিলে দশহাত শাড়িতে সর্বাঙ্গের লজ্জা নিবারণ করা যাবে কি?

[আরও পড়ুন: রক্তের টিপছাপ! ভোটের দিন আরও প্রকট হয় শৃঙ্খলাহীনতার দিকটি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement