shono
Advertisement

সততার প্রতিমূর্তি এবং স্বচ্ছতা অভিযানের কান্ডারিকে নিয়েই যত প্রশ্ন

পেগাসাস ও ‘পিএম কেয়ার্স’ ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর ‘সততা ও নৈতিকতা’ নিয়ে তৈরি হয়েছে এক গভীর ঘূর্ণাবর্ত।
Posted: 06:06 PM Oct 06, 2021Updated: 06:06 PM Oct 06, 2021

পেগাসাস ও ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর ‘সততা ও নৈতিকতা’ নিয়ে তৈরি হয়েছে এক গভীর ঘূর্ণাবর্ত। প্রধানমন্ত্রীর নামে তহবিল, মন্ত্রিসভার সদস্যরা ট্রাস্টি, তহবিলে অশোক স্তম্ভের ছবি, ঠিকানা; অথচ তার সঙ্গে সরকারের কোনও সম্পর্কই নেই! এত প্রকাণ্ড বিস্ময় ভূ-ভারতে আর কিছু আছে কি না সন্দেহ! তবে সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছে, যেহেতু এতে সরকারের টাকা নেই, আইন করে তহবিল তৈরি হয়নি, চলে স্বেচ্ছানুদানে, একে ‘রাষ্ট্রীয়’ তহবিল বলা যাবে না। তাই কত টাকা জমা, কোথায় খরচ, কোনও কিছু জানার অধিকারই নাগরিকদের নেই। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

 

দিন কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বিরোধীদের সমালোচনা করে বলেন, প্রতিশ্রুতি নানা কারণে পালন করা না-ই যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতির কথা লিখে ভোটে জিতে পুরোপুরি ডিগবাজি খাওয়া এবং তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি’ ও রাজনৈতিক ধোঁকাদারি।

উদাহরণ হিসাবে প্রধানমন্ত্রী আধার কার্ড, জিএসটি, কৃষি আইন, সামরিক সম্ভার কেনার পাশাপাশি নতুন সংসদ ভবন নির্মাণেরও উল্লেখ করেছেন। বিরোধীরা নাকি এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েও পিছিয়ে এসেছে। তাঁর মতে, এটা ক্ষমাহীন অপরাধ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এতদিন ধরে সরকার চালানো হয়েছে কী করে পরবর্তী সরকার গড়া যায় সেই লক্ষ্যে। কিন্তু আমার মৌলিক চিন্তাভাবনা আলাদা। আমি বিশ্বাস করি সরকার চালাতে হয় দেশ গঠনের জন্য।

[আরও পড়ুন: অবসরের নির্দিষ্ট বয়স নেই, ক্ষমতা হস্তান্তরই বড় চ্যালেঞ্জ ভারতীয় রাজনীতিতে]

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনেকগুলো ভিন্ন প্রশ্ন ও যুক্তির জন্ম দিয়েছে যেগুলো সঙ্গে সঙ্গে করা যেত। প্রশ্নকর্তা সেসবের ধারকাছ দিয়ে হাঁটেননি। তেমন করলে এই সাক্ষাৎকারের সুযোগই হয়তো পেতেন না! অ-প্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চান না বলেই প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। সংসদের অভ্যন্তরে সাংসদদেরও প্রশ্ন করার অধিকার দেননি। অথচ অনায়াসে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’-র প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেত। জিজ্ঞেস করা যেত- কী ছিল সেই রহস্যময় গোপন যুক্তি যা রাফাল মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে সন্তুষ্ট করেছিল? অবসর গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করা নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কি না জানতে চাওয়া যেত। অথবা, জিজ্ঞেস করা যেত- তাঁর ভাবনায় ‘দেশ’ ও ‘নিকটজনের উন্নয়ন’ সমার্থক কি না। কিন্তু এই জাতীয় অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলির অবতারণা হয়নি। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে অস্বস্তিদায়ক অবস্থায় পড়তে হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী সেই সাক্ষাৎকারে দুটো চমকপ্রদ মন্তব্য করেছেন। যেমন- সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমি গান্ধীজির নীতি মনে রাখি। দেখি, আমার সিদ্ধান্ত দেশের গরিব ও দুর্বলদের উপকার অথবা ক্ষতি করবে কি না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যদি দেখি কোথাও সামান্যতমও কায়েমি স্বার্থ রয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি তা বন্ধ করে দিই। কিন্তু সিদ্ধান্ত একশো ভাগ খাঁটি হলে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে তা রূপায়ণ করি।

পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, বেশ হত প্রশ্নকর্তা যদি জানতে চাইতেন- আচমকা লকডাউনের সিদ্ধান্তের ফলে লক্ষ লক্ষ গরিব ও দুর্বল পরিযায়ী শ্রমিকের অবর্ণনীয় দুর্দশা তাঁকে বিন্দুমাত্র ব্যথিত করেছে কি না। অলক্ষে দু’-বিন্দু অশ্রু তিনি ফেলেছেন কি না। অথবা নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত কি না।দ্বিতীয় মন্তব্যটা সমালোচনা সংক্রান্ত। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি সমালোচকদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সমালোচকের সংখ্যা নিতান্তই কম। অধিকাংশই সমালোচনার নামে অভিযোগ জানান। সমালোচনা করতে গেলে পরিশ্রম করতে হয়। পড়াশোনা করতে হয়। গবেষণা করতে হয়। হতে পারে আজকের এই গতিময় জীবনে লোকেদের হাতে অত সময় নেই। তাই মাঝে মাঝে আমি সমালোচকদের অভাব অনুভব করি।

পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, ‘সমালোচনা’-র সংজ্ঞা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী কী জবাব দিতেন? কোনটা সমালোচনা আর কোনটা নিছক অভিযোগ, কীভাবে সেই ফারাক করতেন? কিংবা জানাতেন কি, যথার্থ সমালোচনায় কোনও সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিয়েছেন কি না? ফেরালে কোনটা? কিন্তু সেই সুযোগ তিনি দেননি। সাক্ষাৎকারের পরতে পরতে তাই জ্বলজ্বল করছে প্রধানমন্ত্রীর ‘সততা ও নৈতিকতা’। এবং তার পাশে বিরোধীদের ‘রাজনীতিক ধোঁকাদারি’ বা ধাপ্পাবাজি।

তাঁর সরকারের গৃহীত দু’টি সিদ্ধান্ত নিয়ে এই মুহূর্তে আদালতে কাটাছেঁড়া চলছে। পেগাসাস কেলেঙ্কারি ও ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল। বেশ হত এই দুই বিষয়ে প্রশ্নকর্তা যদি আলো ফেলতেন। অবশ্য তা কি আদৌ সহজবোধ্য হত? যে-যুক্তি সরকার আদালতে দিয়েছে, সেই যুক্তিরই অবতারণা হত। তাছাড়া, পাশ কাটানোর অজুহাতও তো মজুত। ‘আদালতের বিচারাধীন’।

সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা না-করার জন্য এমন যুক্তি শাসক দলের সদস্যরা ইদানীং আকছার দিচ্ছেন। শাসকদলীয় স্পিকার তা মেনেও নিচ্ছেন। যদিও এমন হাজারটা ‘বিচারাধীন’ বিষয় আছে যা নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। পেগাসাস ও ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল প্রধানমন্ত্রীর ‘সততা ও নৈতিকতা’-কে ঘিরে এক গভীর ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করেছে। এই দুই বিষয় নিয়ে বিরোধীরা যা করছে, তা প্রকৃত সমালোচনা, না কি অন্ধ রাজনৈতিক বিরোধিতা- এই সাক্ষাৎকারের পর সে প্রশ্ন ওঠানো অসংগত নয়। খোদ আদালতেই সেই প্রশ্ন উঠেছে। আর সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীর ‘নৈতিকতা’ চলে এসেছে আতশকাচের তলায়।

পেগাসাস ও ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ও তার যথার্থতা প্রমাণে যাবতীয় যুক্তি ‘সফেদ ঝুট’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেই ‘অপরাধ’ ঢাকতে এক অদ্ভুত ঢালের আমদানি হয়েছে আজকাল- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। দেশের নিরাপত্তা জড়িত, তাই রাফালের দাম জানানো যাবে না। নিরাপত্তার কারণে পেগাসাস প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে কি না বলা যাবে না। বললেই নাকি জঙ্গিরা তা এড়ানোর টোটকা বের করে ফেলবে! সমাজে প্রতিষ্ঠিত এত মানুষের ফোনে কেন আড়ি পাতা হয়েছে জানতে চাওয়া যাবে না। কেননা, ‘সরকার সব কিছু আইন মেনে করছে’। সরকার ছাড়া আর কারও অভিমত বা রিপোর্ট বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ, সেটা দেশপ্রেমিকসুলভ কাজ নয়। একমাত্র সরকারকেই বিশ্বাস করতে হবে। সরকার বলছে, তাই চিনা ফৌজ ভারতের জমি দখল করেনি মেনে নিতে হবে। চিন আগ্রাসী না হলে পূর্ব লাদাখে সংঘর্ষ কেন হল, সেই প্রশ্নও করা যাবে না। কারণ, এই ধরনের ‘অবান্তর’ প্রশ্ন একমাত্র অর্বাচীন ও দেশদ্রোহীদেরই মানায়!

ঠিক এই কারণে “প্রাইম মিনিস্টার’স সিটিজেন অ্যাসিসট্যান্স অ্যান্ড রিলিফ ইন ইমারজেন্সি সিচু্যয়েশন ফান্ড”(পিএম কেয়ার্স তহবিল) নিয়েও প্রশ্ন তোলা বা সন্দিহান হওয়া ঘোরতর অন্যায়। কারণ, তা প্রধানমন্ত্রীর ‘সততা ও নৈতিকতা’-কে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে! প্রধানমন্ত্রীর নামে তহবিল, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা ট্রাস্টি, তহবিলে অশোক স্তম্ভের ছবি, ঠিকানাও প্রধানমন্ত্রীর অফিস; অথচ তার সঙ্গে সরকারের নাকি সম্পর্কই নেই! হলফনামায় এত বড় ‘সফেদ ঝুট’, এত প্রকাণ্ড বিস্ময় ভূ-ভারতে আর কিছু আছে কি না সন্দেহ! কিন্তু তাতে কী? সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছে, যেহেতু এতে সরকারের টাকা নেই, আইন করে তহবিল তৈরি হয়নি এবং তহবিল চলে স্বেচ্ছানুদানে, সেহেতু একে ‘রাষ্ট্রীয়’ তহবিল বলা যাবে না। অথচ এই তহবিলের বিজ্ঞাপনে সরকারি কোষাগার অর্থ খরচ করেছে। সরকারি কর্মীদের বেতন জমা পড়েছে। সরকারি তহবিল নয়, তাই তাতে কত টাকা জমা পড়েছে, কোথায় কত খরচ হয়েছে, কোনও কিছু জানার অধিকারই নাগরিকদের নেই! কী অসাধারণ যুক্তি!

নৈতিকতা ও সততার প্রতিমূর্তি এবং স্বচ্ছতা অভিযানের কান্ডারি কেন এই অস্বচ্ছতার আবরণে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন তা অনুমান সাপেক্ষ। কোন সত্য চাপা দিতে তিনি আগ্রহী, সেই প্রশ্ন তোলা কিছুতেই অসংগত হতে পারে না। প্রশ্ন করার অধিকার যিনি হরণ করেছেন, সংসদের কাছে জবাবদিহির দায়ও তিনি রাখতে চান না। নিজেকে যে কোনও ধরনের নজরদারির আওতা থেকে পৃথক রাখা যাঁর লক্ষ্য, তাঁকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় কি না- সেই উত্তর আপাতত বিচারালয়ের অলিন্দে বন্দি। বৌদ্ধিক অসততা ও রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজদের তুলোধোনা করে প্রধানমন্ত্রী নিজেকেও কি সেই আসনে বসালেন না? ন্যায়ালয় যে নিদানই দিক, প্রশ্নটা কিন্তু উঠবেই। কারণ, তা অবান্তর নয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অনুগামীরা বলতেই পারেন, জনতার রায় তাঁদেরই পক্ষে। অতএব ‘হু কেয়ার্স?’

[আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ছাড়া গতি নেই ভোজনবিলাসীদের! কোথায় হারাল গঙ্গার ইলিশ?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement