shono
Advertisement

‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’

১৮৬০ সাল নাগাদ ‘আইপিসি’ তৈরি হয়। আর রাষ্ট্রদ্রোহ আইন তৈরি হয়েছে ১৮৭০ সাল নাগাদ।
Posted: 02:17 PM May 12, 2022Updated: 02:17 PM May 12, 2022

শেষমেশ সুপ্রিম কোর্ট সেডিশন চার্জ বা রাজদ্রোহিতার আইনের অপব্যবহার নিয়ে মুখ খুলল এবং স্থগিতাদেশের অস্থায়ী সিদ্ধান্তও নিল। এত শীঘ্র পদক্ষেপ প্রশংসনীয় তো বটেই, অভাবনীয়ও। কিন্তু, ভারতীয় আইনে কেবল এটিই তো ভয়ংকরতম আইন নয়। এর চেয়েও কঠোর আইন ‘ইউএপিএ’, যার অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত কিছু কম নয়। লিখছেন জহর সরকার

Advertisement

 

কটা ‘বৈপ্লবিক’ জাজমেন্ট দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ‘রাজদ্রোহ’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’-র আইনে স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এর পক্ষে মহামান্য আদালত নয়। ১৮৬০ সাল নাগাদ ‘আইপিসি’ তৈরি হল। আর এই আইন তৈরি হল ১৮৭০ সাল নাগাদ। প্রযুক্ত হল আরও বিশ বছর খানেক পরে। আইপিসি-র অন্তর্গত ১২৪ ধারার মধ্যে ‘১২৪ এ’ লিখে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এই আইন। এর ইতিহাস তেমন অজানা নয়। কথা ছিল, দেশ স্বাধীনতার পর এই আইপিসি-র বিলোপ ঘটানো হবে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে, জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এই আইনের ভুক্তভোগী হয়েও, আইনটিকে তুললেন না।

‘রাজদ্রোহী’-র অর্থ, যে কিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে বিপ্লবের হুংকার দিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত ২০-২৫ বছরে, এই দেশে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রাজ্যে, যে-ই রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাকেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু ‘সরকার’ ও ‘রাষ্ট্র’ তো এক নয়। সরকার আসে-যায়, রাষ্ট্র চিরস্থায়ী। ফলে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কিছু দায়িত্ব রয়েছে, যেগুলি সরকার থাক বা না-থাক, তা পালন করে যেতে হবে। এমন পরিমণ্ডলে, সরকারের বিরুদ্ধে বলা মানেই রাষ্ট্রর বিরুদ্ধে বলা- এটা সেই সরকার স্থাপনে নির্বাচিত দল বা দলগোষ্ঠীর অহংকারের ব্যাপার। সরকার বা সরকারের প্রধানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করার অন্যায়টা চলছিল বহুদিন ধরেই।

[আরও পড়ুন: ভারতীয় রাজনীতিতে অব্যাহত প্রতিহিংসার ধারা, সংবিধানের শক্তি কি গতায়ু?]

যা হোক, শেষমেশ সুপ্রিম কোর্ট এই আইনে স্থগিতাদেশ জারি করল। যদিও, এটা কিন্তু ‘চূড়ান্ত’ ঘোষণা নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বেরবে সাংবিধানিক বেঞ্চে গিয়ে। সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঁচ থেকে সাতজন বিচারক থাকবেন। কিন্তু এই জারি হওয়াটাও বেশ স্পষ্ট। এত শীঘ্র যে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্তে এল, এটাই অকল্পনীয়।

এখন কথা হল, রাষ্ট্র সবসময় নিজেকে বিপন্ন মনে করে। তার মনে হয়, তার চারপাশে সারাক্ষণ শত্রু ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং শত্রুসংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্র দেখিয়েও দেবে, বা সত্যিই হয়তো ঘটবে এমন যে, শত্রুর উপস্থিতি রয়েছে। তাই শত্রুর দমন দরকার। কিন্তু এর উলটোদিকে, এই আইনের অপব্যবহারও তো রয়েছে। বেশ কিছু রাজ্য সরকারও এই আইনকে ব্যবহার করেছে।

এতকাল বিভিন্ন সরকার এই ‘১৪৪ এ’ তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরেই বলেছে, একটু ভেবে দেখছি। এবার, সুপ্রিম কোর্টের এই অস্থায়ী সিদ্ধান্তে, প্রধান বিচারপতি যে-কথাটি বললেন, তাতে মোটামুটি ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম হয়ে গেল। তিনি বললেন- বেশ, তোমরা ভেবে দ্যাখো, কিন্তু যতদিন না ভেবে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছ, ততদিন এই আইনও কোনওভাবে বলবৎ করা যাবে না।

এই পদ্ধতিটা যদি আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের ‘ভেবে দেখছি, ভেবে বলছি’ আচরণ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এই অস্থায়ী নির্দেশিকাগুলোয় যেটা হয়, সবসময় সরকারের পক্ষে যায় মাঝের সময়টা। কিন্তু এবার সরকারের বিরুদ্ধে গেল। এই নির্দেশে, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সুপ্রিম কোর্টকে সম্মান জ্ঞাপন করে শেষমেশ একটা হুমকি দিলেন যে, সীমা অতিক্রম করা হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের বিষয়ে নাক গলানো হয়ে যাচ্ছে। এই মন্তব্য অপ্রীতিকর। এটা সরাসরি হুমকি ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।

কিন্তু এই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে স্থগিতাদেশ এলেও এর চেয়েও নির্মম যে আইন আছে, তা হল সন্ত্রাসবিরোধী আইন, যেটা হল ‘ইউএপিএ’। এই আইনে যে ছ’বার সংশোধন ঘটেছে, তার মধ্যে ২০১৯-এ যে সংশোধন হয়েছে, তার মধ্যে একটা ভয়ংকর সংশোধন ঘটেছে। এখন, ‘ইউএ’ মানে “আনল’ফুল অ্যাক্টিভিটি”- এই সক্রিয়তা তো কোনও ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কোনও একটা সংগঠনের পক্ষেই বেআইনি কার্যকলাপ সম্ভব। কিন্তু ২০১৯-এর সংশোধনে কেন্দ্রীয় সরকার যোগ করল- শুধু সন্ত্রাসবাদী সংস্থা নয়, সন্ত্রাসবাদী মানুষকেও গ্রেপ্তার করা হবে! ফলে, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে মানুষকেও এরা গ্রেপ্তার করতে লাগল। এই সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ধিক্কার জানিয়েছে রীতিমতো।

এখন আমার চিন্তা, রাষ্ট্রদ্রোহী সন্দেহে অভিযুক্তকে তবু বিচারে তোলার ব্যাপার রয়েছে, কিন্তু এই ইউএপিএ-তে অভিযুক্তকে কবে বিচারে তুলবে, তার কিচ্ছু জানা যাবে না। এবং এখনও অবধি ইউএপিএ আইনে অভিযুক্তরা অপরাধী অবধি গড়িয়েছে- এর সাফল্য হার খুব খারাপ এই রাষ্ট্রে। মাত্র ২ শতাংশ। মানে, সন্দেহের শেষ নেই। এখন, যদি সত্যি কেউ রাষ্ট্রর শত্রু মনে হয়, তার বিচার হোক না। কিন্তু বিচার করতে রাষ্ট্র নারাজ। অর্থাৎ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে আইনের অপব্যবহারের প্রসঙ্গ চলেই আসছে। যেমন ফাদার স্ট্যান স্বামী। একটা অশীতিপর মানুষ, যাঁর পারকিনসন’স রয়েছে, জল খেতে গেলে স্ট্র লাগে, তাঁকে কী করে সন্ত্রাসবাদী ঠাওরানো সম্ভব? লোকটা তো অসুস্থ অবস্থায় শেষমেশ মারাই গেলেন। ফলে, আমার সন্দেহ হচ্ছে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে স্থগিতাদেশের জন্য ইউএপিএ আইনে না সাব্যস্ত করতে শুরু করে এরা!

(মতামত নিজস্ব)
লেখক রাজ্যসভার সদস্য
(কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

[আরও পড়ুন: ৩৫৬ চাওয়া হয়নি নোয়াপাড়া, দমদমেও! তফাত ভুলে গেলেন?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement