অবশেষে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হানল ইজরায়েলের মাটিতে। শনিবার মধ্যরাত থেকে প্রায় ঘণ্টাপঁাচেক যেভাবে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলেছে, তা বেনজির। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
ইজরায়েলের বুকে ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল। ইজরায়েল বরাবর এই ধরনের হামলার জুজু সারা বিশ্বকে দেখিয়ে এসেছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত ইজরায়েলের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আয়াতুল্লাহ খোমেইনি তেহরানের মসনদে বসার পর থেকে ইরান (Iran) ও ইজরায়েলের (Israel) সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হয়েছে। পরবর্তী কালে দু’দেশের মধ্যে ‘ছায়াযুদ্ধ’ও শুরু হয়েছে। ইরানি মদতপুষ্ট লেবাননের হেজবুল্লা জঙ্গিগোষ্ঠী ও ইয়েমেনের হাউথি জঙ্গিরা লাগাতার ইজরায়েলের উপর হামলা চালিয়ে এসেছে। হামাসের পিছনেও ইরানের মদত সুবিদিত।
লাগাতার ছায়াযুদ্ধ চলতে থাকলেও এত দিন দু’দেশের মধ্যে সরাসরি হামলার ঘটনা ঘটেনি। ইজরায়েলের বরাবরের আতঙ্ক, জেরুসালেম-সহ তাদের দেশ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতাভুক্ত, ইরানের হাতে যদি পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তা হলে যে কোনও মুহূর্তে তারা ইজরায়েলের বুকে বড়সড় কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত ইরান সেই ক্ষেপণাস্ত্র হানা ঘটাল। তবে এটা সম্পূর্ণ বলে-কয়ে। এক্ষেত্রে প্ররোচনা যে ইজরায়েলের পক্ষ থেকেই এসেছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে ইরানের কনসুলেট বাড়িটির উপর আচমকা ইজরায়েলের ফাইটার জেট গিয়ে কেন হামলা চালাল, তার কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। ইরানকে পাল্টা হানার প্ররোচনা দিতেই যে এপ্রিল মাসের ১ তারিখে ইজরায়েল এই হামলা করেছিল, তা মনে করে মুসলিম বিশ্ব। ওই হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর শাখা ইসলামি রেভলিউশনারি গার্ডের দুই জেনারেল-সহ একাধিক আধিকারিক মারা গিয়েছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, ইরানের সেনাবাহিনীর কর্তারা দামাস্কাসের ওই কনসুলেট দফতরে বসে নাকি প্যালেস্তিনীয় ইসলামিক জেহাদি গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। ইজরায়েলি গোয়েন্দারা সেই তথ্য পেয়ে যান। প্যালেস্তিনীয় জঙ্গিদের নিশানা করেই ইজরায়েলি সেনা হামলাটি চালায়।
[আরও পড়ুন: গোয়া নির্বাচনে ছিলেন আপের আর্থিক দায়িত্বে, লোকসভা ভোটের আগে ইডির হাতে গ্রেপ্তার সেই চনপ্রীত]
দামাস্কাসের ওই হামলার পরেই ইরান প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়ে দেয়। মার্কিন গোয়েন্দাদের দেওয়া সময়সীমা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে ইরান পালটা হামলা চালিয়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু করে প্রায় ঘণ্টাপঁাচেক যেভাবে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তা চমকে দিয়েছে বিশ্বকে। ইজরায়েলের আকাশ যে সতি্যই সুরক্ষিত, তার প্রমাণও অবশ্য মিলেছে। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাসের হামলার সময় ‘আয়রন ডোম’ কাজ করেনি। হামাস জঙ্গিরা নাকি ‘আয়রন ডোম’ প্রযুক্তিটি অচল করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ইরানের হামলার সময় প্রত্যক্ষ করা গেল, দূর পাল্লা ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন আকাশে প্রতিরোধ করার প্রযুক্তি ইজরায়েলের যথেষ্ট অঁাটসঁাট। যদিও সমর বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার কাজে বড় ভূমিকা ছিল মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি ও জর্ডন সেনার। ইজরায়েলি বায়ুসেনার একটি ঘঁাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র সামান্য ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। কয়েকজন ইজরায়েলি নাগরিকও অল্পবিস্তর আহত। এক আরব বেদুইন বালিকার অাঘাত গুরুতর। কিন্তু ইরানের ৩০০টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই প্রতিহত হয়েছে।
হামলার মধ্য দিয়ে ইরান তাদের বাহিনীর পালটা আঘাত হানার ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ইজরায়েলের সাধারণ মানুষের প্রাণহানি কিংবা অসামরিক ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো ইরানের লক্ষ্য ছিল না বলে বলা হচ্ছে। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, তঁাদের লক্ষ্যপূরণ হয়েছে। শোধবোধ হয়ে গিয়েছে। কারণ, ইরানও নাকি চাইছে না, এই ঘটনাটি একটি বড় যুদ্ধের আকার নিক। ইরানের এই হামলার কীভাবে জবাব দেওয়া হবে, তা নিয়ে ইজরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা দীর্ঘ বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচে্য আবার একটি বড় যুদ্ধ কিছুতেই চাইছে না। মার্কিন প্রশাসন ইজরায়েলের উপর চাপ তৈরি করেছে পাল্টা প্রতিশোধে না যাওয়ার জন্য।
[আরও পড়ুন: বিরোধীদের ভূরি ভূরি অভিযোগের মাঝেই ইডিকে দরাজ সার্টিফিকেট মোদির]
আমেরিকায় এ-বছর ভোট। মধ্যপ্রাচে্য আবার একটা যুদ্ধের অর্থ মার্কিন অর্থনীতির উপর চাপ। কোভিড মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মার্কিন অর্থনীতি জেরবার। আমেরিকায় গত কয়েক বছরে যে-হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে ঘটেনি। অর্থনীতি কার্যত মন্দার মুখে দঁাড়িয়ে। ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলার সামরিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করার জন্য প্রবল চাপ রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপর। ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করতে হয়েছে। ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচে্য তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বলে মার্কিন সমর-বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ইরানের সমর্থনে রয়েছে চিন ও রাশিয়া। রাশিয়া ইতিমধে্য ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। অামেরিকা হামলায় অংশ নিলেই তারা ইরানের হয়ে নামবে বলে হঁুশিয়ারি দিয়েছে। মুসলিম ভোট হাতছাড়া হওয়ার অাশংকাও কাজ করছে বাইডেনের। সেটা ঘটলে বেশ কিছু ‘সুইং স্টেট’ তঁার হাতছাড়া হতে পারে।
ইজরায়েল-ইরান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে ভারত সরকারও। ইরানের হামলার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এই দাম আকাশ ছেঁাবে। কারণ বন্ধ হয়ে যাবে হরমুজ প্রণালী। যেখান দিয়ে পরিবহণ করা হয় বিশ্বের এক চতুর্থাংশ অশোধিত তেল। অশোধিত তেলের দাম চড়া হারে বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পেট্রোল-ডিজেলের দাম ধরে রাখা মুশকিল হবে। ভোট প্রক্রিয়ার মধে্য পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়াতে হলে শাসক দল বিজেপির পক্ষে সেটা এক অস্বস্তিকর ঘটনা হবে। ফলে ভারতও চাইছে যে কোনও মূলে্য মধ্যপ্রাচে্যর এই উত্তেজনা প্রশমিত হোক।
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘরে-বাইরে চাপের মধে্য। হামাসের হামলার পর দেশের মধে্য তঁার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। ১৩০০ ইজরায়েলির মৃতু্যর বদলা নিতে তিনি যেভাবে গাজায় ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন, তাতে বহির্বিশ্বেও তঁার উপর প্রবল চাপ। গাজা থেকে নজর ঘোরাতেই যদি নেতানিয়াহু সিরিয়ায় ঢুকে ইরানের দূতাবাসে হামলা করে এই সংকট তৈরি করে থাকেন, তাহলে তিনি যে উত্তেজনাকে বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ফলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াবে, তা এখনও সুস্পষ্ট নয় কূটনৈতিক মহলের কাছে। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব গুয়েতেরেস বলেছেন, খাদের কিনারে দঁাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ প্রায় অনিবার্য বলেই তঁার আশঙ্কা।