রেমালের খামখেয়ালে বঙ্গে বর্ষার দুই রূপ। উত্তর-পূর্ব ভারতের মৌসুমি বায়ুকে শক্তিশালী করে উত্তরবঙ্গকে করে তুলেছে বানভাসি। আবার, বিপদে ফেলেছে দক্ষিণবঙ্গকেও। যেটুকু মেঘ এদিকে জমেছিল, টেনে নিয়ে গিয়েছে উত্তরে। আবহাওয়ার বিমাতৃসুলভ মনোভাবে মানুষ বিপর্যস্ত। লিখছেন দেবদূত ঘোষঠাকুর।
রাজ্য একটাই। তার একপ্রান্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে জলভরা মেঘ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেন বলছে, ‘মেঘ দে, পানি দে’। আর, অন্যপ্রান্তটি হাতজোড় করে আকাশকে বলছে, ‘সব জল ভরা মেঘ নিয়ে যাও। ঢেলে দাও ফারাক্কার ওপাশে’। দক্ষিণবঙ্গ ফুটিফাটা। উত্তরবঙ্গ বানভাসি। প্রকৃতির কী আজব খেয়াল!
অজয় নদী আর কোপাই পরপর পার হয়ে গেল ট্রেনটা। নিচে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম। কে বলবে আষাঢ়স্য প্রথম দিবস! অজয়ের বুকে পুরু বালির স্তর। মাঝে কয়েকটা মাত্র জায়গায় মিশে জল। তাতে বোধহয় পায়ের পাতাও ডুববে না। আর কোপাইয়ের কথা যত না বলা যায়, ততই ভাল। চুলের ফিতের মতো এক চিলতে জলধারা। নিকাশি নালাও বোধহয় এর থেকে বেশি স্রোতস্বিনী। দু’-ধারের চাষের মাঠে ঘাস পুড়ে গিয়েছে। যত দূর চোখ যায় হলুদ প্রান্তর। ওই পুড়ে যাওয়া ঘাসের নিচে ফুটিফাটা জমি।
[আরও পড়ুন: ভোটে ধাক্কার পরেই ‘অন্নদাতা’দের কল্যাণ মোদির! ১৪ শস্যের MSP বাড়াল কেন্দ্র]
এক বন্ধু কোচবিহারের বাংলাদেশ সীমান্তর কাছে থেকে নৌকায় চেপে তোর্সা নদীর জলস্তর নিয়ে আপডেট দিচ্ছিলেন– ‘পাহাড়ে বৃষ্টি না থামলে আশপাশের সব এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে।’ জেলা প্রশাসনের হয়ে জল মাপতে গিয়েছিলেন তিনি। ওই বন্ধুর পাঠানো তার আগের দিনের ছবিতেই দেখছিলাম তিস্তার বিশাল জলরাশি ধাক্কা মারছে সেতুর আশপাশের ফোল্ডারে। সেটা শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সেবক ব্রিজের ছবি।
দুই বঙ্গের আবহাওয়ার কেন এই দ্বিচারিতা?
১০০ বছরের নথির ভিত্তিতে আবহাওয়া দফতর ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্ষা কবে নাগাদ ঢোকে তার নির্ঘণ্ট তৈরি করছে। সেই মতো উত্তরবঙ্গে বর্ষা ঢোকার কথা ১ জুন। দক্ষিণে ৮ জুন। বড়জোর নির্ধারিত সময়ের পঁাচ দিন এদিক-ওদিক হওয়ার কথা। এবার উত্তরবঙ্গে বর্ষা ঢুকেছে নির্দিষ্ট সময়ের একদিন আগে। অর্থাৎ, ৩১ মে। শুধু ঢুকেই ক্ষান্ত দেয়নি, বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এমনকী, পড়শি রাজ্য সিকিমেরও একাংশ দেশের মূল অংশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণবঙ্গে ৮ জুনের পরে
১০ দিন কেটে গেলেও বর্ষার দেখা মেলেনি এখনও।
[আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী থেকে বিরোধী দলনেতা, আড়াই দশক পর ওড়িশায় ‘কুরসি বদল’ নবীন পট্টনায়েকের]
আবহবিদরা বলছেন, উত্তরবঙ্গে এই যে দুর্যোগ, তার পিছনে ঘূর্ণিঝড় রেমালের হাত রয়েছে। কীভাবে? তাঁদের অনেকেই জানাচ্ছেন, রেমাল বাংলাদেশের মংলার কাছ দিয়ে স্থলভূমিতে ঢুকে সোজা চলে গিয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে। সেখানে থাকা মৌসুমি বায়ুকে শক্তিশালী করে তুলেছে। অসমে বন্যা ঘটিয়ে সেই জোরালো মৌসুমি বায়ুই ঢুকেছে উত্তরবঙ্গে। কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে সেই বাতাস স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ফলে, সব মেঘ গিয়ে জড়ো হয়েছে সিকিম পাহাড়ে। ফলশ্রুতি– এই প্রবল বারিধারা। চলছে পক্ষকাল ধরে। পাহাড় থেকে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ নিচের দিকে না-নামলে উত্তরবঙ্গের বাকি তিন জেলা– দুই দিনাজপুর ও মালদহ যে অনাবৃষ্টির কবলে পড়বে, তা আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন আবহবিদরা। রেমাল শুধু উত্তরবঙ্গকেই সংকটে ফেলেনি। বিপদ ডেকে এনেছে দক্ষিণবঙ্গেরও। দক্ষিণবঙ্গের উপরে যেটুকু মেঘ জমছিল, সেটাও উত্তর-পূর্বের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাহলে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দক্ষিণবঙ্গ নিয়ে আশার কথা কেন শুনিয়েছিল আলিপুর আবহাওয়া দফতর?
কেন্দ্র সরকারের আবহবিজ্ঞান মন্ত্রকের প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথের মত, ১০ জুন বঙ্গোপসাগরের মায়ানমার উপকূলে একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছিল। সেটি মধ্য ভারতে আটকে থাকা মৌসুমি বায়ুর অন্য একটি অংশকে দক্ষিণবঙ্গে নিয়ে আসবে বলে অনেকে ভেবে নিয়েছিল। সেইমতো আশার বাণী শোনানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। কেন? আবহবিদরা বলছেন, এর জন্য দায়ী জোরালো পশ্চিমি বাতাস। এই পশ্চিমি হাওয়ার দাপট চৈত্র-বৈশাখে একটাও কালবৈশাখি হতে দেয়নি দক্ষিণবঙ্গে। কলকাতায় তাপমাত্রা ছঁুয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একটানা সাত দিন তাপপ্রবাহে পুড়েছে দক্ষিণের জেলাগুলি। ২৬ মে রেমাল নামের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পরে আশা করা গিয়েছিল বর্ষা এবার ঠিক সময়েই আসবে। কিন্তু বাধ সাধল সেই পশ্চিমি বাতাস। মায়ানমারে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে গরম পশ্চিমি বাতাসকে। তাহলে বর্ষা কবে আসবে দক্ষিণবঙ্গে?
[আরও পড়ুন: ভোটে ধাক্কার পরেই ‘অন্নদাতা’দের কল্যাণ মোদির! ১৪ শস্যের MSP বাড়াল কেন্দ্র]
আবহাওয়াবিদরা ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আয়লা পরবর্তী অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই বছর ২৫ জুন আয়লা দক্ষিণ ২৪ পরগনা-বাংলাদেশ উপকূলে আছড়ে পড়ে। ঝড়-বৃষ্টিতে নাজেহাল হয়ে পড়ে দক্ষিণবঙ্গ। দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা ঢুকল বলে তড়িঘড়ি ঘোষণাও করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেদিন বর্ষা ঢোকেনি। ঢুকেছিল ২৩ জুন। আসলে বর্ষার ভগীরথ হল বঙ্গোপসাগরে জোরালো কোনও ঘূর্ণাবর্ত কিংবা নিম্নচাপ। আবহবিদরা বলছেন, পশ্চিমি বাতাসের তীব্রতা কিছুটা কমেছে। এই সময় একটা নিম্নচাপ কিংবা জোরালো ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হলেই কেল্লা ফতে। দক্ষিণবঙ্গ বর্ষার জন্য তার দরজা খুলে দেবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
ghoshthakur@gmail.com