shono
Advertisement

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কি নেতিবাচক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী?

তাঁর বিজ্ঞান মনস্কতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে আজকের বিজ্ঞানীদের। The post আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কি নেতিবাচক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী? appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 01:55 PM Oct 02, 2020Updated: 01:57 PM Oct 02, 2020

ঋত্বিক আচার্য: মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (Mahatma Gandhi)। বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত জননেতা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কান্ডারি। জাতির জনক। যিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। যার জীবনই তাঁর বার্তা। সার্ধ শতবর্ষ পেরিয়েও যার প্রভাব জনমানসে অমলিন। সেই সুমহান ব্যক্তির উন্নয়নশীল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির প্রতি নাকি ছিল প্রবল অনীহা। এই নিয়ে তাঁর কম সমালোচনা হয়নি। সমালোচনায় শামিল হয়েছেন বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা এমনকি তার খুব কাছের মানুষরাও। আসলে কেমন ছিল তাঁর আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ধ্যানধারণা ? সত্যিই কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ছিল তাঁর একপেশে নেতিবাচক মনোভাব?

Advertisement

মহাত্মাকে নিয়ে যাবতীয় আলোচনার প্রায় সবটাই হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তাঁর বিজ্ঞান মনস্কতা নিয়ে আলোচনার বেশিরভাগটা জুড়েই রয়েছে তদানীন্তন ব্রিটিশ আদব-কায়দায় সমাজ ও শিল্প গড়ে ওঠা নিয়ে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। অলডাস হাক্সলি বোধহয় প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন গান্ধীর খাদি আন্দোলন নিয়ে। তিনি পরিষ্কার বলে দেন, গান্ধীর এই আন্দোলন বিজ্ঞানের পরিপন্থী। হাক্সলির এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সবাইকে অবাক করে জওহরলাল নেহরু বলেন যে তিনিও গান্ধীর এই মনোভাবের সঙ্গে একমত নন। নেহরুও গান্ধীর যুক্তি সঠিক মনে করেননি। বরং তিনি বলেন যে খাদি আন্দোলনের বিকাশ নিয়ে গান্ধীর মনোভাব যথাযথ হলেও বৃহত্তর শিল্পোন্নয়নে গান্ধীর মনোভাব সঠিক নয়। অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধীর বিদেশি উন্নত বিজ্ঞান বিরোধী মনোভাবের প্রবল সমালোচনা করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এমনকি তদানীন্তন জাতীয় কংগ্রেসও গান্ধীর এই ব্যক্তিগত মনোভাব সমর্থনে করত না।

[আরও পড়ুন: মধ্যস্বত্বভোগীদের মৌচাকে ঢিল, লাইসেন্স-রাজ খতম করবে কৃষি বিল]

সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা ভারতের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও গান্ধীর বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে ছিল নেতিবাচক মনোভাব। স্বাধীন ভারতের শিল্প পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা গান্ধীর বিজ্ঞান ভাবনাকে পশ্চাদগামী ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন যে উন্নত জীবনযাত্রার জন্য আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনও বিকল্পই হয় না। উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে ছেড়ে গরুর গাড়ি বা চরকাকে আঁকড়ে ধরায় তিনি কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি।

তবে মহাত্মা গান্ধী বিজ্ঞান বিরোধী ছিলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি বোধহয় অনেকটাই একপেশে হয়ে যায়। তার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয় তদানীন্তন সময়ে বা পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে এ বিষয়ে কোনও বিশদ গবেষণা না হওয়া। গান্ধীর চিঠিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে খাদি বা চরকা বা এই সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনায় তিনি এই বিষয়গুলিকে বারবার বিজ্ঞান বলেই উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত ১৯২৯ সালে গান্ধীজি এক অভিনব প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। হালকা, টেকসই (অন্তত ২০ বছর টিকবে) এবং উন্নত সুতো উৎপাদনকারী চরকা বানাতে পারলেই বিজয়ী পাবে নগদ পুরস্কার। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধী বস্তুত চেয়েছিলেন দেশি প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যা দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দেবে। পাশাপাশি শক্তিশালী করবে দেশের শিল্প পরিকাঠামোকে। বিদেশি প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা অনেক বেশি জটিল হবে বলে মনে করতেন তিনি।বিজ্ঞানকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতেন মহাত্মা। তাঁর মতে, বিজ্ঞান শুধুমাত্র জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং প্রান্তিক মানুষকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাঁদের সঙ্গে করে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই সঠিক বিজ্ঞান।

তিনি আরও মনে করতেন যে পাশ্চাত্যের দেশগুলির তথাকথিত উন্নত বিজ্ঞান তাঁদের মানসিকতাকে একেবারেই উদার ও সহিষ্ণু করতে পারেনি। গান্ধীজি বরাবর বলে এসেছেন, তিনি যেমন বিজ্ঞানের অন্ধ সমর্থক নন, তেমনই ভারতীয় প্রথাগত রীতি রেওয়াজের বিষয়ে আবেগপ্রবণও নন। গান্ধী মনে করতেন, বিজ্ঞান ছাড়া যেমন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তেমনই বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগের বিষয়ে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। বিখ্যাত কবিরাজ গ্রন্থনাথ সেন একবার গান্ধীজির কাছে জানতে চান কবিরাজি বিদ্যা নিয়ে তাঁর মনোভাবের কথা। উত্তরে তিনি জানান যে কবিরাজি নিয়ে তিনি যথেষ্ট আগ্রহী ও আস্থাশীল হলেও সঠিকভাবে শিক্ষিত কবিরাজের অভাব চোখে পড়ার মতো। তাঁর মতে, প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত বইগুলিতে যা লেখা আছে, তার সমস্ত কিছু সঠিক এমনটাও নয়। বরং প্রাচীন তথ্যের পাশাপাশি আধুনিক আবিষ্কারই ভারতের চিকিৎসাকে সমৃদ্ধ করবে।

[আরও পড়ুন: ‘রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’, বোফর্স নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল কি হয়নি?]

গান্ধীজি ভালোভাবেই জানতেন যে তাঁকে বিজ্ঞান বিরোধী মনে করা হয়। গান্ধীজির জীবনীকার রামচন্দ্র গুহ এই প্রসঙ্গে ১৯২৫সালে গান্ধীজির ত্রিবান্দ্রামে (আজকের তিরুঅনন্তপুরম) কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশে দেওয়া একটি ভাষণের উল্লেখ করেছেন। গান্ধীজি সেই ভাষণে বলেছিলেন, ”বিজ্ঞান ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের যথার্থ ভাবেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে আর সেই সীমাবদ্ধতার জায়গাটা হলো মনুষত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাত।” তিনি জানান তাঁর উদ্বেগের কথা – ”ভারতবাসী গ্রামে বাস করে, শহরে নয়। তাঁদের কাছে কিভাবে
পৌঁছাবে এই নগরকেন্দ্রিক আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির সুফল?” ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর প্রতিশ্রুতিবান বিজ্ঞানীদের গান্ধী বলেন যে বাইরের এবং ভিতরের গবেষণাকে এক করার কথা, যার মধ্যে সবসময় থাকবে নৈতিক ও সামাজিক দিক। গবেষণায় পাশ্চাত্বের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে
চিন্তা ব্যক্ত করেছেন গান্ধীজি। নবীন গবেষকদের সামনে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনে মানুষের দরজায় দরজায় পৌঁছে যেতে রাজি ছিলেন তিনি।

সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে আজ গান্ধীর বিজ্ঞান মনস্কতা নতুন করে আলোচনার বিষয়। ”প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া” – সবচেয়ে সমালোচিত গান্ধীর যে মত তাঁকে বিজ্ঞান বিরোধী তকমা জুটিয়ে দিয়েছিল, আজ সেটাই জীববৈচিত্র্য বাঁচানোর একমাত্র পথ বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ভয়াল রূপ দেখে মহাত্মা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তার পরবর্তী স্বরূপ আজ পরিষ্কার আমাদের কাছে। বিজ্ঞান যে জীবনের অনেক মানবিক দিক কেড়ে নিয়েছ, তা নিয়ে আমাদের কোনও সংশয় নেই। সত্য এবং অহিংসাকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে কোনওদিন চিন্তাই করেননি গান্ধী। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে গান্ধীর বিজ্ঞান মনস্কতা প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও বর্তমান প্রেক্ষিতে গান্ধীর বিজ্ঞান নিয়ে মনোভাব যে অনেকটাই ইতিবাচক ছিল, তেমনই মনে করছেন গান্ধী বিশেষজ্ঞরা।

The post আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কি নেতিবাচক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী? appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement