shono
Advertisement

জল পড়ে, পাতা নড়ে না

কীভাবে সম্ভব বিপন্মুক্তি?
Posted: 07:02 PM Mar 29, 2024Updated: 07:02 PM Mar 29, 2024

মহারাষ্ট্রের পর এবার বেঙ্গালুরু। দেশের আরও একটি ‘মেগা সিটি’ জলসংকটে ত্রস্ত। একদা এই শহরে জলাভূমির অভাব ছিল না। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরোন্নয়নের প্রভাবে বেঙ্গালুরু এখন জলহারা। লোকসভা ভোটের প্রচারে দেশব্যাপী জলসংকট কি নির্বাচনী ইস্যু হতে পারছে? লিখলেন সুপ্রতিম কর্মকার

Advertisement

বেঙ্গালুরু (Bengaluru) আয়তনে ৭৪১ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ১ কোটি ৪০ লক্ষর আশপাশে। তবে এই শহরের আরও একটি পরিচয় আছে– ‘সিটি অফ লেকস’। এক সময় কর্নাটকে ২৬,৯৯৪টি জলাশয় ছিল। এর মধ্যে ২১,১২০টি জলাভূমির এখন কোনও অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ ৭৮.২ শতাংশ জলাভূমি রাজ্য থেকে চুরি হয়ে গিয়েছে। এবার আসা যাক ‘গ্রেটার বেঙ্গালুরু’র কথায়। একদা ২৬৫টি জলাভূমি ছিল। অথচ, এমন এক লেকের শহর থেকে ৭৯ শতাংশ জলাভূমি অন্তর্হিত। এমনই তথ্য তুলে ধরেছে দিল্লির ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর রিপোর্ট। তাতে লেখা হয়েছে– ‘Centre for Science and Environment’ (CSE), echoed that the number of water bodies in the city has reduced by 79% in the past four decades due to unplanned urbanisation and encroachment. Simultaneously, built-up area has increased from 8% in 1973 to 77% presently.

প্রশ্ন উঠবেই, এত জলাশয় বোজানোর সময় স্থানীয় প্রশাসন কী করছিল? সামগ্রিকভাবে দেখলে, দেশজুড়ে জলাভূমি নিয়ে দুর্নীতির চেহারা প্রায় এক। সরকারি জমি ও জলাশয় একের পর এক কার্যত দিনের আলোয় ভরাট হয়েছে। জলাজমির চরিত্রকে ‘অবৈধভাবে’ সরকারি রেকর্ডে পাল্টানো হয়েছে। অথচ, ‘বেঙ্গালুরু ডেভলপমেন্ট অথোরিটি’ কোনওরকম আইনি পদক্ষেপ করেনি। ১৯৯৬ সালে তৈরি ‘বেঙ্গালুরু মেট্রোপলিটান টাস্ক ফোর্স’ ২০১৩ সালে জলাভূমি বিষয়ে সক্রিয় হলে দেখতে পায়– বিপুল পরিমাণ সরকারি জলাভূমি ভরাট হয়েছে অবৈধভাবে। পদক্ষেপস্বরূপ: যারা জলাভূমি ভরাট করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘কর্নাটক ল্যান্ড রেভেনিউ অ্যাক্ট, ১৯৬৪’-এর অধীন ক্রিমিনাল কেস করা হয়।

[আরও পড়ুন: ২৫০ কোটির মালকিন রণবীর-আলিয়ার মেয়ে রাহা! কীভাবে জানেন?]

অনস্বীকার্য, বেঙ্গালুরুতে জলের সংকট প্রাকৃতিক কারণেই ছিল। আর, সেই জলসংকট থেকে বঁাচার জন্যই এত জলাশয়ের নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে বছরে গড়ে ৫০০ থেকে ১,৩৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। সমস্যা হল, বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ২৫ শতাংশ ভূপৃষ্ঠের প্রবাহ ‘রাজা কালুভে’ নামের স্টর্মওয়াটার ড্রেনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই মূল্যবান বৃষ্টির ধারাকে ধরে রাখার পরিকাঠামো বেঙ্গালুরুতে নেই, বা যেটুকু ছিল, তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাবে বৃষ্টির জল-বহনকারী ঝরনাগুলিও বিনষ্টপ্রায়। ফলে স্টর্মওয়াটার যে নিকটবর্তী জলাশয়ে পৌঁছে যাবে, সেই পথটিও স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বেশিরভাগ হ্রদ পলিতে বোঝাই। অ্যাপার্টমেন্ট, কমপ্লেক্স, বহুতল ভবন শহরটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থকে দখল করে ফেলেছে। আগে যে বেঙ্গালুরু একটু শুষ্ক হয়ে উঠলেই আশপাশের জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস সেখানে ভেসে আসত, ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তনের ফলে তা অনেকখানি বাধা পেয়েছে। শুষ্ক আবহাওয়া আগের থেকে বেশি সময় ধরে এখন তাই থাকে। যা দু’-দশক আগেও থাকত না।

বেঙ্গালুরুর ভৌগোলিক অবস্থান দেখলে বোঝা যায়, পুরো শহরটি দুটো নদী অববাহিকায় বিভক্ত। শহরের পূর্বদিকের অংশটি পোন্নাইয়ার নদীর অববাহিকার মধ্যে পড়ে। আর-কিছুটা অংশ আরকাভাথি নদীর অববাহিকার অংশ। শহরের পশ্চিমের অংশটি কাবেরী অববাহিকার অন্তর্গত। বেঙ্গালুরু শহরের লাগোয়া (পেরি-আর্বান) অংশটি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। পেরি-আর্বান এলাকার বাইরে দিয়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একটি ‘বেল্ট’ ছিল। উন্নয়নের কোপে এই সবুজে-ঘেরা অঞ্চলটি সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার দশা। যদিও কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর দাবি যে, গত বছরে বৃষ্টি কম হওয়ার জন্য বেঙ্গালুরু শহরে জলের এমন তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে।

[আরও পড়ুন: কঙ্গনার অনুপ্রেরণাতেই রাজনীতিতে কৃতী স্যানন? ভোটের মুখে বড় কথা অভিনেত্রীর!]

পশ্চিমে আরকাভাথি অববাহিকায় ‘বৃষভবতী স্ট্রিম সিস্টেম’। এর সঙ্গে পোন্নাইয়ার নদী অববাহিকা, হেব্বল ও কোরামঙ্গলা-চাল্লাঘাটা (কেসি) উপত্যকার ভূ-রূপতাত্ত্বিক, ভূ-জলতাত্ত্বিক, এমনকী জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যেরও বড় পার্থক্য আছে। বৃষভবতী অববাহিকার নদীব্যবস্থার যে-কাঠামো, তা অনেকটা খাড়া। প্রধান উপনদী নগরভবী-থোরাই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত। অন্যদিকে, পোন্নাইয়ার অববাহিকার প্রবাহ-ঢাল অনেকটা পূর্বদিকে এবং মৃদু। এই এলাকাটি উত্থিত মালভূমি। হেব্বাল ও কেসি উপত্যকার জলনিকাশি ব্যবস্থা প্রাকৃতিকভাবে ‘প্রশস্ত, অগভীর ও অস্থির’। পোন্নাইয়ার অববাহিকায় শিলাস্তর তীব্র রাসায়নিক আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। কাজেই রাসায়নিক আবহবিকারের প্রভাব এখানে প্রকট। গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫-৩০ মিটার উঁচুতে থাকা এলাকাটি পুরু কাদামাটি স্যাপ্রোলাইটে পরিবর্তিত হয়েছে।

ঘন এঁটেল স্যাপ্রোলাইটের উপর আবার ২-৩ মিটার পুরু এঁটেল ল্যাটেরাইট মাটি রয়েছে। তার উপর দঁাড়িয়ে রয়েছে কংক্রিট শহরের আবরণ। এসব কারণ মাটির নিচে জলের অনুপ্রবেশ রোধ করেছে। তার উপর অভেদ্য কাদামাটি স্যাপ্রোলাইট এবং ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৩০০ মিটার নিচে থাকা বিশাল শিলাদেহ, যা একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চল তৈরি করেছে। এই কঠিন শিলার নিচে যেটুকু জল জমেছিল, তা ছিল বহু যুগ আগের। সেই মাটির তলার জলসম্পদকেই বিগত দুই দশক ধরে তোলা হয়েছে– অবিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য বোরওয়েল দিয়ে। যার ফলে এই ভৌগোলিক এলাকা শুকিয়ে যাওয়ার পথে। এখন দরকার বৃষভবতী নদীর ডানতীর বরাবর যেসব ‘অ্যাকুইফার’ বা মাটির তলার জল ধরে রাখার আধার রয়েছে, তাকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ‘রিচার্জ’ করার ব্যবস্থা করা। তা হয়তো বেঙ্গালুরুর জলসংকটের মোকাবিলায় সাহায্য করবে।

অতি সম্প্রতি শহরের স্থানীয় প্রশাসন জল অপচয়ের জন্য ২২টি পরিবারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তা-ই নয়, পঁাচ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে তাদের। পানীয় জলের অপব্যবহার রুখতে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই বেঙ্গালুরু শহরে ‘ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়ারেজ বোর্ড’ কিছু নির্দেশিকা জারি করেছে। গাড়ি ধোয়া, বাগান করা, নির্মাণকাজ, ফোয়ারা, বিনোদন, সিনেমা হল ও শপিং মল ও রাস্তা-নির্মাণের জন্য পানযোগ্য জল-ব্যবহার করা হয়েছে নিষিদ্ধ। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কড়া শাস্তির দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে ‘বেঙ্গালুরু জল সরবরাহ বোর্ড’। তাদের তথ্য বলছে, দিন পনেরোর মধ্যেই সব মিলিয়ে ১.১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। অপরাধীরা যদি কেউ ফের অপরাধ করে, সেই ক্ষেত্রে প্রতিবার আদেশ লঙ্ঘনে ৫০০ টাকা করে অতিরিক্ত জরিমানা আরোপ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।তবে শুধু জরিমানা ও শাস্তি নয়। জলসংকট থেকে বেঙ্গালুরু শহরকে বঁাচাতে হলে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর জোর দিতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতা।
(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement