shono
Advertisement

‘কৃবু’, ‘নবু’, না ‘এআই’?

‘কলিনস ডিকশনারি’-র এই বছরের সেরা শব্দ ‘এআই’।
Posted: 03:01 PM Dec 26, 2023Updated: 03:01 PM Dec 26, 2023

‘কলিনস ডিকশনারি’-র এই বছরের সেরা শব্দ ‘এআই’– আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইতোমধ্যে এটি বহুল ব্যবহৃত। বাংলায় ‘এআই’ লেখা হয়, কিন্তু আমরাও কি পারি না একটি সুন্দর ও যথাযোগ্য পরিভাষা খুঁজে বের করতে? কেননা, আপাতত ‘এআই’-এর সঙ্গে ঘর তো করেই যেতে হবে। লিখলেন অতনু বিশ্বাস

Advertisement

‘কলিনস ডিকশনারি’ তাদের ২০২৩ সালের বচ্ছরকার শব্দ অর্থাৎ ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ হিসাবে নির্বাচিত করেছে ‘এআই’-কে (AI)। বিভিন্ন নামজাদা অভিধানই ব্যবহারকারীদের ব্যবহারের পরিমাণ হিসাব করে এরকম বছরের ‘সেরা’ শব্দ নির্বাচন করে থাকে বছরের শেষে। তাতে খানিক শোরগোল ওঠে, ডিকশনারিগুলির প্রচারও খানিক হয় নিশ্চয়ই। তবে সেই সঙ্গে মানুষের সমাজটা যে কাকে অক্ষ করে কীভাবে আবর্তিত হচ্ছে, এবং সেই সঙ্গে গড়িয়ে যাচ্ছে ‘হুপ রোলিং’-এর মতো, তারও খানিক হদিশ মেলে বইকি।

আন্তর্জালের এই রমরমার দুনিয়ায় বিভিন্ন শব্দর ব্যবহার বা বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে তাদের অনুসন্ধানের হিসাব রাখা আজকাল খুবই সহজ। যাই হোক, সাম্প্রতিক অতীতে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নিয়ে যেমন অভূতপূর্ব মাতামাতি চলেছে দুনিয়াভর, তাতে সে-সংক্রান্ত কোনও না কোনও শব্দ যে কোনও একটা ডিকশনারির বচ্ছরকার শব্দরূপে নির্বাচিত হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! যেমন, ‘কেমব্রিজ ডিকশনারি’-র এ বছরের সেরা শব্দ ‘হ্যালুসিনেট’, বা অবাস্তব কিছু কল্পনা করা। এ শব্দটাও মাত্রাতিরিক্ত প্রচার পেয়েছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-র সময়বিশেষে খামখেয়ালিপনার দৌলতে।

[আরও পড়ুন: সামনেই নির্বাচন, সাইবেরিয়ার ভয়ংকর জেলে খোঁজ মিলল পুতিনের ‘শত্রু’ নাভালনির]

‘মেরিয়ম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি’ আবার সেরা শব্দ নির্বাচন করেছে ‘অথেনটিক’-কে, যা নিয়ে প্রশ্ন গাঢ়তর হয়ে উঠছে ‘জেনারেটিভ এআই’-এর মিথ্যা ছবি, ভিডিও, অডিও কিংবা লেখা বানিয়ে তোলার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই। এবং ‘কলিনস ডিকশনারি’-র ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শব্দরূপে যে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নয়, বরং তার ‘অ্যাক্রোনিম’ বা সংক্ষিপ্ত রূপ ‘এআই’ নির্বাচিত হয়েছে, সেটা কিন্তু সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে কতটা পরিমাণে আমাদের জীবন, জীবনশৈলী, এবং কথোপকথনের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে, তার একটা ছবি পাওয়া সম্ভব এর মধ্য দিয়ে।
আমাদের জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই বিপ্লব, এই দুর্বার জোয়ারটা এসেছে বছরখানেক, কি বড়জোর বছর দেড়েক। ২০২২-এর অক্টোবরের শেষে ‘চ্যাটজিপিটি’ বাজারে আসাকে মোটামুটি এই ধারার ক্ষেত্রে ‘ইনফ্লেক্সন পয়েন্ট’ বা আনতি-বিন্দু হিসাবে ধরা যেতে পারে। জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রসমূহে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পায়ের ছাপ যে ক্রমেই গভীর হয়ে চলেছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গণ্ডি। এখন চ্যাটবটের সঙ্গে কথোপকথন চালানো যায়। প্রশ্ন করলেই ‘কম্পু’-র মতো চটজলদি জবাব হাজির। ডেল-ই কিংবা মিডজার্নির মতো ছবি তৈরির ‘জেনারেটিভ এআই’ দিয়ে করা যাচ্ছে ইচ্ছামতো ছবি তৈরি। শুধু কী ছবি, ইচ্ছামতো ‘ডিপফেক’ ভিডিও কিংবা অডিও বানিয়ে কঁাপন ধরিয়ে দেওয়া যায় সভ্যতার শিরদঁাড়ায়। দাবা কিংবা অন্যান্য নানা বোর্ড গেমের শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়দের তুড়ি মেরে হারিয়ে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ডিপফেক যেমন ডিপার ফেক হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই ডিপ ব্লু হয়ে ওঠে ডিপার ব্লু। আসলে, কৃত্রিম বুদ্ধির সীমানা বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমেই। চিকিৎসায়, নিরাপত্তায়, যোগাযোগে, বিনোদনে, ব্যাঙ্কিংয়ে, এবং আরও কত কীসে যে, তার পুরো তত্ত্বতালাশ করা অসম্ভব। এমন একটা প্রবন্ধর মধ্যে তো নয়ই। আর তার কোনও
প্রয়োজনও নেই।

[আরও পড়ুন: পাক নির্বাচনে মুম্বই হামলার অন্যতম চক্রী হাফিজ সইদ! মৌলবাদীদের দখলে যাবে ইসলামাবাদ?]

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন দুনিয়ার বহু বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, এবং অগণিত সাধারণ মানুষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাই অজস্র ইস্যু– তার নতুন অবতারের আত্মপ্রকাশ, সমাজের নানা ক্ষেত্রে সেসবের সুবিধা, অসুবিধা, বিপদ, বিবর্তন, নিয়ন্ত্রণ, আইন, তার প্রয়োগের সম্ভাব্যতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের তত্ত্বতালাশ করাও কঠিন, এবং তার অনেকটাই অনুমান-নির্ভর। এসব নিয়ে লেখা হয়ে চলেছে অজস্র আর্টিকল-ও। নানা পত্রপত্রিকায়, কাগজে, ম্যাগাজিনে, আন্তর্জালে। ঘটনাচক্রে আমিও এ নিয়ে ইতিমধ্যেই লিখেছি বেশ কিছু নিবন্ধ, কিছু বাংলায় কিছু ইংরেজিতে। সে-প্রসঙ্গেই ‘এআই’-এর বছরের সেরা শব্দ নির্বাচিত হওয়া নিয়ে এক নতুন চিন্তা মাথায় এল। সাহস করে সেটাই বলতে চাই এ প্রবন্ধে।

‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ শব্দবন্ধটির প্রথম ব্যবহার কিন্তু অনেক আগে। সেই ১৯৫৬-তে। স্ট্যানফোর্ডের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি-ই প্রথম ব্যবহার করেন শব্দবন্ধটি। কথাটা লোকের মুখে মুখে ফিরতে অবশ্য সময় লেগেছে বেশ খানিকটা। এখন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে কোনও আর্টিক্‌লের ক্ষেত্রেই শব্দবন্ধটা ব্যবহার করতে হয় বারবার। বিষয়টা একটু ক্লান্তিকর হয়ে পড়ে। পাঠকেরও হয়তো একটা একঘেয়েমি আসতে পারে এর ফলে।

তাহলে উপায়? ইংরেজিতে লিখলে সমস্যা কম। একবার ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ পাশে লিখে বন্ধনীর ভিতরে তার অ্যাক্রনিম ‘এআই’ লিখে ফেললেই হয়। তারপর ওই সংক্ষেপিত রূপ ‘এআই’-ই ব্যবহার করা যায় বারবার। এতে লেখক এবং পাঠক উভয়েরই ক্লান্তি খানিক কমে বলে আমার অন্তত মনে হয়েছে। আর, এখন যখন ‘এআই’ নিজেই একটা শব্দ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, অদূরভবিষ্যতে হয়তো আর ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ কথাটা লেখার দরকারই হবে না। প্রথম থেকেই ব্যবহার হতে থাকবে ‘এআই’-এর।

কিন্তু বাংলায় লিখলে বিষয়টা এতটা সহজে মেটে না। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর বাংলা হিসাবে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ শব্দবন্ধটি না-হয় এক-দু’বার ব্যবহার করা গেল। অনেকে অবশ্য ‘কৃত্রিম মেধা’ ব্যবহার করেন দেখেছি। সেটা তঁাদের নির্বাচন, যদিও এক্ষেত্রে ‘মেধা’ শব্দটা আমার খুব একটা সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয় না; বরং ‘বুদ্ধিমত্তা’ অনেকটা ঠিকঠাক।
কিন্তু তারপর? ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-র যে কোনও দিক নিয়ে বাংলায় হাজার-বারোশো শব্দের একটা আর্টিক্‌ল লিখতে গেলে অন্তত দশ-পনেরো-বিশবার ব্যবহার করতে হয় শব্দবন্ধটা। ইংরেজির ‘এআই’-এর মতো এর কোনও সংক্ষেপিত রূপ তো নেই।

আমরা অবশ্য ‘এআই’-কে বহুবার ব্যবহার করি বাংলায় প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রেও। তাতেও বড় একটা অসুবিধে নেই। ইংরেজির বহু শব্দ কিংবা বহু অ্যাক্রোনিম-ই তো আমরা অক্লেশে ব্যবহার করি বাংলায়। যেমন– ‘ডিএনএ’, ‘ইউবিআই’ (ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম), ডিএ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ‘এআই’-টা আমাদের বারবার ব্যবহার করতে হচ্ছে, এবং অদূরভবিষ্যতেও হবে। তাহলে কি বাংলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা অ্যাক্রোনিম তৈরি করা যায় না? মূলস্রোতের হিন্দিভাষী ভোটারদের সুবিধার্থে যেমন করে ‘বিজেপি’-র বিকল্প থাকে ‘ভাজপা’ কিংবা ‘এসপি’-র সঙ্গে চালু থাকে ‘সপা’, তেমনই না হয় হল।

কিন্তু ‘কৃবু’-টা বড্ড বাজে শোনায়। ‘আর্টিফিশিয়াল’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে যদি ‘নকল’ ব্যবহার করা হয়, তাহলে হতে পারে ‘নবু’। সত্যি বলতে কী, এটাও খুব একটা ভাল শোনাচ্ছে না। তবে কিনা বহুল পরিমাণে ব্যবহার হতে থাকলে যে কোনও কিছুই সয়ে যায়। তাই অ্যাক্রোনিম হিসাবে যেটাই চালু হোক, তার বহুল ব্যবহার চাই। নইলে তার বড় একটা সার্থকতা নেই। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর এই বাংলায় অ্যাক্রোনিম তৈরিটা অবশ্য শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিকদের কাজ নয়। এ-কাজে যঁারা ‘এআই’ নিয়ে বিশেষজ্ঞ, তঁাদের যোগদান সবচেয়ে জরুরি। প্রযুক্তি নিয়ে টালমাটাল সভ্যতার এই সন্ধিক্ষণে হোক না তৈরি একটা ছোট্ট বাংলা পারিভাষিক শব্দ। এটা শুধুমাত্র ভাষার জন্যই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে লেখালেখির জন্য, এবং আলোচনার জন্য। আগামী কিছু বছরে যার ব্যবহার হতে পারে সহস্র সহস্র বার। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু তৈরি না হলে বাংলাতেও ‘এআই’ চলতে পারে গড়গড়িয়ে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement