shono
Advertisement

আমেরিকায় কি ‘নিষিদ্ধ’ হবে ‘টিকটক’?

১৫০টি দেশের ৩৯টি ভাষায় ৫০ কোটি মানুষ ‘টিকটক’ ব্যবহার করে, যার মধ্যে ১২ কোটি মার্কিনি।
Posted: 03:40 PM Mar 13, 2023Updated: 03:40 PM Mar 13, 2023

১৫০টি দেশের ৩৯টি ভাষায় ৫০ কোটি মানুষ ‘টিকটক’ ব্যবহার করে, যার মধ্যে ১২ কোটি মার্কিনি। এই অ্যাপকে কি অত সহজে বাগে আনা যায়? তাই মার্কিন সেনেটে এসেছে নতুন বিল। ‘রেস্ট্রিক্ট’। যা আইনে পরিণত হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিন, রাশিয়া, ইরান, কিউবা, ভেনিজুয়েলা-সহ উত্তর কোরিয়ার যে কোনও প্রযুক্তি ‘নিষিদ্ধ’ করতে পারবেন। কলমে কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

ট্রাম্প জমানা থেকেই চলছে ওয়াশিংটন-বেজিং প্রযুক্তি যুদ্ধ, যা বিশ্বের সামনে বহুলাংশে এসেছে বাণিজ্য যুদ্ধ আর তাইওয়ান নিয়ে পারস্পরিক রণ-হুংকারের মোড়কে। তাইওয়ান নিয়ে চিনের আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান কারণ-ই হল এই দ্বীপ রাষ্ট্রকে দখল করে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের জিওনকাঠি সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে বিশ্বে নিজেদের ‘রাজ’ কায়েম করা (কারণ বিশ্বের সিংহভাগ ‘সেমিকন্ডাক্টর’ তৈরি করে তাইওয়ান)। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেলুন কাণ্ডের মাধ্যমে সেই প্রযুক্তি-যুদ্ধেরই আর-এক পর্বের উন্মোচন হয়েছে খোদ মার্কিনিদের ঘরের মধ্যে। চিনা অ্যাপ নিয়ে এই বিবাদ হল সেই পর্বেরই নবতম পর্যায়। আদতে এক শঙ্কা তিরতির করে বয়ে চলেছে ওয়াশিংটনের চিন্তা-ভাবনায়। কী সেই শঙ্কা?

যে কোনও যুদ্ধের অন্যতম শর্ত-ই হচ্ছে শত্রুর উপর নজর রাখা। ওয়াশিংটন মনে করছে- বেজিং সেই প্রক্রিয়ায় নেমে পড়েছে। ছলে-বলে-কৌশলে তাদের উপর নজর রাখার জন্য বেলুন, অ্যাপ এসবের প্রয়োগ হচ্ছে। বেলুন যেমন গোপনে আকাশে স্পাই ক্যামেরা নিয়ে নিচের ভৌগোলিক এলাকার ছবি তুলছে, তেমনই ‘টিকটক’-এর মতো অ্যাপ মার্কিন জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য সংস্থার চিনে থাকা সার্ভারে পাচার করছে, যাতে সময়মতো সেসব তথ্য কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটনকে বিপাকে ফেলা যায়। আর, চিনা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর জিয়ন কাঠি যে বেজিংয়ের হাতে, এটাও অজানা নয়।

[আরও পড়ুন: কূটনীতির ট্রাপিজ, ইউক্রেন যুদ্ধে কীভাবে নিরপেক্ষ থাকবে ভারত?]

নিন্দুকরা তো বলেই যে, ‘চিনা কমিউনিস্ট পার্টি’ বা ‘সিপিসি’-র বিরাগভাজন হয়ে কারও পক্ষেই চিনে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তাই সিপিসি-র কথামতোই চলতে হয় চিনা শিল্পমহলকে। অন্যথা হলে কী হয়, তা আলিবাবা-র জ্যাক মা-র দশা দেখলেই অনুমান করা যায়। (যে জ্যাক মা ছিলেন চিনের সবচেয়ে বড় ধনকুবের, এখন তিনি শিল্পজগৎ থেকে সন্ন্যাস নিয়েছেন। শোনা যায়, শি জিনপিং জমানার সমালোচনা করার পরই তাঁর এই হাল।) পেন্টাগনের তাই শঙ্কা, চিনা বহুজাতিক সংস্থাগুলি আদতে বেজিংয়ের হয়েই বিদেশে চরবৃত্তি করে। ফলে, টিকটকের মতো সংস্থার অ্যাপের আমেরিকার জনজীবনে খুল্লামখুল্লা থাকা জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ মার্কিন-বিরোধী প্রচারের মঞ্চ হিসাবে এই ভিডিও অ্যাপ ব্যবহার হতেই পারে।

এসব সাত-পাঁচ ভেবেই রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাট দু’-দলের ৬ জন করে সদস্য মার্কিন সেনেটে এক বিল এনেছেন। নামটা বেশ বড়। ‘রেস্ট্রিক্টিং দ্য ইমার্জেন্স অফ সিকিউরিটি থ্রেট্‌স দ্যাট রিস্ক ইনফরমেশন্‌স অ্যান্ড কমিউনিকেশনস টেকনোলজি’- যাকে সংক্ষেপে ‘রেস্ট্রিক্ট’ বলা হচ্ছে। এই বিল আইনে পরিণত হলে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিন, রাশিয়া, ইরান, কিউবা, ভেনিজুয়েলা আর উত্তর কোরিয়ার মতো ৬টি দেশের যে কোনও প্রযুক্তির ব্যবহার আমেরিকায় ‘নিষিদ্ধ’ করতে পারেন। বলা বাহুল্য, প্রথম কোপ ‘টিকটক’-এর উপরেই পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিনদের আরও যুক্তি- এতদিন খাপছাড়াভাবে ‘হুয়াই’ বা ‘জেটিই’-র মতো চিনা প্রযুক্তি সংস্থাকে মার্কিন সরকারি কাজকর্ম থেকে বের করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই ধরনের কাজের কোনও সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। ‘রেস্ট্রিক্ট’ আইনে পরিণত হলে এই খামতি দূর হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু হঠাৎ এই জনপ্রিয় ভিডিও অ্যাপের দিকেই নজর কেন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ধরনের বিদেশি সংস্থার প্রযুক্তি সরাসরি জনগণের সঙ্গে সংযোগ করছে। আর, যেহেতু এটি চিনের অ্যাপ- তাই চিন্তার মাত্রাটাও বেশি। অবশ্য চিনা অ্যাপ নিয়ে হোয়াইট হাউসের আশঙ্কা বিগত কয়েক বছর ধরেই ক্রমবর্ধমান। ট্রাম্প জমানায় যখন বেজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বাণিজ্য-যুদ্ধ শুরু হয়, তখন এই অ্যাপের বিষয়টা হোয়াইট হাউসের নজরে আসে। ২০২০ সালে অ্যাপল আর গুগ্‌লের প্লে-স্টোর থেকে চিনা অ্যাপ ‘উইচ্যাট’-কে বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়। তখনই প্রায় ২ কোটি মার্কিনি এটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু সরকারের প্রচেষ্টা ধাক্কা খায় আদালতে। মার্কিন বিচারপতি লরেন বিলার ২২ পাতায় রায়ে পরিষ্কার বলেন, অ্যাপ বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমাণ দেওয়া হয়নি। ফলে তখনকার মতো ট্রাম্প সরকারের প্রচেষ্টা পটোম্যাকের জলে ভেসে যায়।

কিন্তু চরবৃত্তির চিন্তাটা রয়েই যায়। বছর দুয়েক আগে টিকটক-সহ ৫৯টি চিনা অ্যাপের ব্যবহার ভারতে ‘নিষিদ্ধ’ হয়। দিল্লির সন্দেহ এসব অ্যাপের মাধ্যমে ভারতীয় গ্রাহকদের তথ্য গোপনে সংস্থাগুলির চিনা সার্ভারে চলে যাচ্ছে, যা ভারতীয় নিরাপত্তার পক্ষে সুখবর নয়। ভারতের বাজার হারিয়ে টিকটকের মালিক সংস্থা ‘বাইটডান্স’ ৬০০ কোটি ডলারের ব্যবসা খোয়ায়। একইভাবে ইউরোপ আর কানাডাতেও ‘টিকটক’-এর উপর বিধি-নিষেধ আনা হচ্ছে।

তবে সম্প্রতি মার্কিন আকাশে চিনা বেলুন পুরো বিষয়টায় যে ঘৃতাহুতি দিয়েছে- সন্দেহ নেই। হোয়াইট হাউস এটিকে চিনের চরবৃত্তির জলজ্যান্ত উদাহরণ বলেছে। আর বেজিং চেষ্টা করেছে নিছক আবহাওয়া পরীক্ষাগার বলে চালানোর। কিন্তু চিঁড়ে ভেজেনি। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে- এই অভিযোগে অতলান্তিকের উপরে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বেলুন ধ্বংস করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এরপর নজর পড়েছে টিকটকের উপরে। ইতিমধ্যেই ১২টি মার্কিন প্রদেশে সরকারি মোবাইলে টিকটক ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে। গোটা কয়েক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও এই চিনা অ্যাপ ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের ১৫০টি দেশের ৩৯টি ভাষায় ৫০ কোটি মানুষ যে-অ্যাপ ব্যবহার করে, (যার মধ্যে ১২ কোটি মার্কিনি), তাকে কি অত সহজে বাগে আনা যায়? তাই এই নয়া আইনের আয়োজন- যাতে প্রযুক্তির আড়ালে চরবৃত্তি রোখা যায়।

স্বাভাবিকভাবে এই মার্কিনি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে চিনা সংস্থা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। ‘টিকটক’ জানাচ্ছে মার্কিন বৈদেশিক লগ্নি সংক্রান্ত কমিটি সিফিউসের কাছে গত আগস্ট মাসে ১৫০ কোটি ডলারের ‘প্রজেক্ট টেক্সাস’ নামে এক পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। এই পরিকল্পনায় বিশদে বলা হয়েছে যে, কীভাবে মূল চিনা সংস্থার আওতায় আমেরিকাতে সহযোগী সংস্থা গড়বে টিকটক– যার কর্ণধাররা নিযুক্ত হবেন ওয়াশিংটনের সবুজ সংকেত পেলে। এই প্রস্তাব নিয়ে এখনও পর্যন্ত মার্কিনিদের কোনও সাড়া পায়নি চিনারা।

কিন্তু এখন মার্কিন সংসদে শুনানির মুখে পড়ার আগেই টিকটকের চিফ এগ্‌জিকিউটিভ অফিসার শৌ জি চিও শুনানি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করা শুরু করেছেন। উদ্দেশ্য- টিকটক যে চিনের চর নয়, তা মার্কিন সাংসদদের বোঝানো। আসরে নেমেছে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত চিনা মিডিয়াও। যেদিন শি জিনপিং উপর্যুপরি তৃতীয়বারের জন্য চিনা প্রেসিডেন্ট হলেন, সেদিনই টিকটক নিয়ে ওয়াশিংটন রাজনীতি করছে- এই অভিযোগ তুলেছে চিনের দৈনিক ‘চায়না ডেলি’। ‘টিকটক বিকামস পলিটিক্যাল ফুটবল, এগেইন’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বেজিংয়ের হয়ে সংস্থার চরবৃত্তির অভিযোগ খারিজ করে বলা হয়েছে- অ্যাপ নয়, এবার এই অযৌক্তিক পদক্ষেপের জন্য জনগণের ক্রোধের মুখে পড়বে ওয়াশিংটন।

আগস্ট, ২০২২-এ চিপ সংক্রান্ত মার্কিন আইনের তুমুল সমালোচনা করার খবরও রয়েছে এই সম্পাদকীয়র পাশে। ‘চিপ্‌স অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট’ শুধু যে চিনের স্বার্থ-বিরোধী তা-ই নয়, এটি অন্য মার্কিন বন্ধুদেশগুলির স্বার্থহানি করছে বলে চিনা দৈনিকের অভিযোগ। এরপরেও
বলব না, ওয়াশিংটন বনাম বেজিং প্রযুক্তি-যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে?

[আরও পড়ুন: ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যেন ‘টিকটক ওয়ার’, প্রচারযুদ্ধে মস্কোকে টেক্কা কিয়েভের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement