আগামী বছর পাকিস্তানে বসতে চলেছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি’-র একদিনের ক্রিকেট আসর। তারা চাইছে, ভারত সেই প্রতিযোগিতায় দল পাঠাক। দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের লক্ষণ ও উদ্যোগ আপাত-দৃশ্যমান না হলেও ক্রিকেট কূটনীতির হাত ধরে বরফ গলতে শুরু করলে ক্ষতি কী? কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দীর্ঘ নবছর পর ভারতের বিদেশমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর। দুই দেশের আকচাআকচি ও গুমট ভাব কি কাটতে চলেছে? ক্রিকেটের হাত ধরে ভারত-পাকিস্তানের কপাট আঁটা সম্পর্কের কি অবসান হতে চলেছে? হঠাৎই এমন সম্ভাবনা উঁকি মারছে। সম্পর্কের বিষয়টা আলোচনার পর্যায়ে উঠে এসেছে। এটাই বেশ ইতিবাচক। অনেক বছর এটাও তো হয়নি।
জয়শংকর পাকিস্তানে ছিলেন ২৪ ঘণ্টারও কম সময়। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইসলামাবাদ পৌঁছে বুধবার বিকেলে দিল্লি ফেরেন। এই অতি সংক্ষিপ্ত সফরের উদ্দেশ্য ছিল ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া। এবার পাকিস্তান ছিল সম্মেলনের আয়োজক দেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বদলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শংকর। কিন্তু তাতে কী এমন হল যে, সম্পর্ক উন্নতির আশা এমন চিকচিক করে উঠেছে?
এ নিয়ে আলোচনা চলছে দুই দেশেই। অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। প্রথমত, নবছর পর ভারতের কোনও বিদেশমন্ত্রী পাকিস্তানে গেলেন। শেষবার গিয়েছিলেন সুষমা স্বরাজ। ২০১৫ সালে। এবার মোদি যে যাবেন না, জানা ছিল। কিন্তু জয়শংকরও না-গেলে পারতেন। দিল্লি থেকে ‘ভার্চুয়াল’ সম্মেলনে যোগ দিতে পারতেন। অথচ তা না করে, তিনি সশরীরে গেলেন।
এই যাওয়া অর্থবহ। আয়োজক দেশকে সম্মান জানানো। দ্বিতীয়ত, সম্পর্কে আড়ষ্টতার আড় যে ভাঙেনি, তা বোঝাতে জয়শংকর অনায়াসেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দেওয়া নৈশভোজের আসর এড়াতে পারতেন। অজুহাতের অভাব হত না। কিন্তু তা তিনি করেননি। বরং সেই আসরে দেখা গেল তিনি ও পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ ইশাক দার-এর পাশাপাশি বসলেন। জানা গেল, সেই অ্যারেঞ্জমেন্ট ইশাক দারেরই করা, যাতে দুজনে কথা বলতে পারেন। সেই আসরে একসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ মোহসিন রাজা নাকভিকেও স্বল্প সময়ের জন্য দেখা যায়। নাকভি পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের চেয়ারম্যান।
পরের দিন ছিল মূল সম্মেলন। জয়শংকর তাঁর ভাষণে সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে ‘তিন অশুভ শক্তি’ হিসাবে জাহির করলেন। সেই সঙ্গে জানালেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতা তখনই সম্ভব– যখন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সার্বভৌমত্বের সাম্যতা থাকে। প্রতিবেশী হিসাবে চিন বা পাকিস্তানের নাম তিনি করেননি। বিতর্কিত মন্তব্যও করেননি। বরং পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসার আগে বলেছেন, "ইসলামাবাদ ছেড়ে যাচ্ছি। আতিথেয়তা ও সৌজন্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী ও পাকিস্তান সরকারকে ধন্যবাদ।"
জয়শংকরের সফর নিয়ে পাকিস্তানের কেউ প্ররোচনামূলক কোনও বিবৃতি দেননি। সাম্প্রতিক অতীতে প্রথমবার এমন হল। বরং সে-দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জয়শংকরকে ‘পাকিস্তানের সম্মাননীয় মেহমান’ বলে অভিহিত করেছেন। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সে দেশের যোজনামন্ত্রী আহসান ইকবাল ‘লাহোর ঘোষণাপত্র’ অনুসরণের উপর জোর দিয়েছেন। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী আতাউল্লা তারার সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এটা বহুপক্ষীয় সম্মেলন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঝালানোর আঙিনা নয়। শালীনতা ও পারস্পরিক সম্মানরক্ষার এই তাগিদ এক বছর আগেও ছিল না। ২০২৩ সালে গোয়ায় বসেছিল এসসিও বিদেশমন্ত্রী সম্মেলন। যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টো জরদারি। ভারতে এসেই তিনি কাশ্মীর পরিস্থিতির সমালোচনা করেছিলেন। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন জয়শংকর। বিলাবলকে বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ শিল্পের মুখপাত্র’।
গোয়ার তিক্ততা ইসলামাবাদে কাটানোর কৃতিত্ব দুই দেশেরই। শাহবাজ শরিফের সঙ্গে জয়শংকরয়ের দুবার ‘সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ও কুশল বিনিময়’ কূটনৈতিক দিক থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর বড় ভাই নওয়াজ শরিফের মন্তব্যে। সম্মেলনের পরদিনই সফররত ভারতীয় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সম্পর্কের জমাট বাঁধা বরফ গলাতে জয়শঙ্করের এই সফর সদর্থক ভূমিকা নেবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া এমন ধরনের মন্তব্য শাসক দলের কারও পক্ষে করা যথেষ্ট ঝুঁকির। শরিফ ভাইদের মনোভাবের নেপথ্যে সেনা সমর্থনের প্রচ্ছন্ন আভাস তাই অনেকে দেখতে চাইছে। সেটা কতদিন স্থায়ী হবে, তা অবশ্যই ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের উপর নির্ভরশীল। তারা এ নিয়ে হইচই বাধালে সরকার সরে আসতে পারে। এতগুলো বছর ধরে এই চিত্রনাট্যই মঞ্চস্থ হচ্ছে।
তবে পাকিস্তানের এবারের অবস্থা আলাদা। অসহনীয় অর্থনৈতিক মন্দায় দেশ জেরবার। মন্দা কাটিয়ে অভ্যন্তরীণ সার্বিক অসন্তোষের সামাল দেওয়া শরিফ সরকারের আশু কর্তব্য। শরিফরা যতটা রাজনীতিক ততটাই ব্যবসায়ী। বরাবর বাস্তববাদী। সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরও বাস্তববাদিতার পরিচয় দিচ্ছেন পশ্চিমের প্রতিবেশীর সঙ্গে কাজ চালানো সম্পর্ক গড়ে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানে। শরিফ সরকার এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না। তবে এখনই তারা সম্পর্ক নিয়ে আকাশকুসুম ভাবতে রাজি নয়।
বরং ধাপে ধাপে এগতে চায়। এসসিও সম্মেলনের অবসরে তারা সেই প্রথম ধাপটিতে পা ফেলতে আগ্রহ দেখিয়েছে। সাবধানী ভারতও। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা বাঁক ও গতির দিকে নজর না রেখে তার উপায় নেই। ভারত যে ঘরপোড়া গরু! আগামী বছর পাকিস্তানে বসতে চলেছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি’-র একদিনের ক্রিকেট আসর। তারা চাইছে, অতীত পিছনে ফেলে ভারত সেই প্রতিযোগিতায় দল পাঠাক। সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে উঠুক। ইসলামাবাদে জয়শংকরের সঙ্গে আলোচনায় ইশাক দার ও রাজা নাকভি সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। এমন প্রস্তাবও তাঁরা দিয়েছেন, ভারত আসতে রাজি হলে তাদের লিগ পর্যায়ের তিনটি ম্যাচ লাহোরে দিতেও প্রস্তুত, যাতে ইচ্ছে করলে ভারত ম্যাচ খেলে আধঘণ্টার মধ্যে দিল্লি চলে যেতে পারে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইশাক দার ওজনদার। নওয়াজ শরিফের কন্যা আসমা তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রর স্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকভির সঙ্গে তাঁর তালমিলও খুব। তাঁরা জানেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতকে আনতে পারলে তা হবে এক বিশাল কূটনৈতিক পদক্ষেপ। ক্রিকেট– এই উপমহাদেশের সর্বত্র যা কিনা অকৃত্রিম, সর্বজনীন ধর্ম– তা দুই দেশের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করতে পারবে। দীর্ঘ ১৭ বছর ভারতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তানে যায়নি।
পাকিস্তানের প্রস্তাবে জয়শংকর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি। বলার কথাও নয়। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে বসছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর। চার মাসে সিন্ধু ও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে যাবে। অনেক কিছু ওলটপালট করে দেওয়ার পক্ষে এই ক’টা মাস যথেষ্ট। অনেক কিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, অজিত দোভালরা। সেই সিদ্ধান্ত হবে পুরোপুরি রাজনৈতিক।
হালের পাকিস্তান কী চায় খোলামেলা, তা জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি নওয়াজ শরিফ। জয়শংকরের সফরের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ভারতীয় সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, "৭৫টা বছর নষ্ট হয়েছে। আমাদের উচিত আগামী ৭৫ বছর নিয়ে ভাবা। অতীত ভুলে আগামীর দিকে তাকাতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলো যেমন একে-অন্যের সঙ্গে থাকে, আমি মনে করি ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য প্রতিবেশীদেরও তেমনই থাকা উচিত। শিল্প, বাণিজ্য, লগ্নি, পর্যটন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সহযোগিতার স্বার্থে।"
শরিফ বলেছেন, "ভারত ও পাকিস্তান আবার একে অন্য দেশে গিয়ে ক্রিকেট খেলুক। ক্রিকেটীয় সম্পর্ক গড়ে উঠুক। এই দুই দেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ফাইনালে উঠলে আমি সেই খেলা দেখতে ভারতে যাব।" ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমন্বিত আলোচনা, ইংরেজিতে যা ‘কম্প্রিহেনসিভ ডায়লগ’, গত দশ বছর ধরে বন্ধ। সম্পর্কের জমাট বঁাধা বরফ গলার কোনও লক্ষণ ও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ক্রিকেট কূটনীতির হাত ধরে সেই বরফ গলতে শুরু করলে ক্ষতি কী? এত শত্রুতা ও রক্তক্ষয়ের পরেও তো চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দিব্যি বহমান! সাউথ ব্লক কি একটু অন্যভাবে ভাবতে পারে না? বিশেষ করে পাকিস্তান যখন হাত বাড়াতে চাইছে? তা ছাড়া কপাট তো যখন-তখন বন্ধ করে দেওয়া যায়?