shono
Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে কি ফিরবে বিধান পরিষদ?

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট আমলে বিধান পরিষদ উঠে যায়।
Posted: 04:00 PM May 29, 2023Updated: 04:00 PM May 29, 2023

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট আমলে বিধান পরিষদ উঠে যায়। মন্ত্রিত্ব যায় কয়েকজনের। বহু দিন ধরে বিধান পরিষদ ফেরানোর ভাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু বিধান পরিষদ চাইলেই তো সহজে করা সম্ভব নয়। রাজ্যপাল থেকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেন্দ্রর বর্তমান সরকার বন্ধুবৎসল নয়। আশঙ্কা তাই থেকেই যাচ্ছে। কলমে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

Advertisement

দেশের সংসদে যেমন রয়েছে লোকসভা এবং রাজ্যসভা- দু’টি কক্ষ। ঠিক তেমনই রাজ্যের আইনসভাতেও দু’টি কক্ষ রয়েছে। রাজ্যের ক্ষেত্রে আইনসভার দু’টি কক্ষ হল- বিধানসভা এবং বিধান পরিষদ। বর্তমানে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে ‘বিধান পরিষদ’ নেই। একসময় থাকলেও প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক আগে তার অবলুপ্তি ঘটেছে। বিধান পরিষদে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন সদস্যরা। দেশের বহু রাজ্য থেকেই এখন বিধান পরিষদ উঠে যাওয়ায় আপাতত হাতেগোনা কয়েকটি রাজ্যে এর অস্তিত্ব টিকে রয়েছে।

এটা ঘটনা, এক সময় পশ্চিমবঙ্গেও বিধান পরিষদ ছিল। কিন্তু ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট আমলে এ-রাজ্য থেকে বিধান পরিষদ উঠে যায়। তখন সেই ঘটনার জেরে বেশ কয়েকজন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ আইনসভায় বিধান পরিষদ অবলুপ্তির একটি প্রস্তাব পাস হয়। এরপর ভারতীয় সংসদেও পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদ (অবলুপ্তি) আইন, ১৯৬৯ পাস হয়েছিল। তারপর, ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট এখানকার বিধান পরিষদ অবলুপ্ত হয়।

১৯৬৭ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়লেও তা স্থায়ী হতে পারেনি। এরপর, ১৯৬৯ সালে অন্তর্বর্তী নির্বাচনে ফের জিতে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল। তখন ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যে কেন্দ্রের সঙ্গে একটা লড়াই পাকাতে রাজ্যে বিধান পরিষদ বিলোপের ইস্যুটা তোলা হয়েছিল। অনেকটা কেন্দ্র বা কংগ্রেসকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে এই ইস্যু সিপিএম তুললেও এর মাধ্যমে পাশাপাশি সিপিআই-কে বেকায়দায় ফেলার একটা উদ্দেশ্য ছিল বলে অনেকেই তখন মনে করতেন।

[আরও পড়ুন: ‘নন্দীগ্রামে রক্তগঙ্গা, মমতাদির ফোন, প্রিয়দাকে ধরো এখনই’…তারপর]

যুক্তফ্রন্টের ৩২ দফা কর্মসূচিতে এই বিধান পরিষদ বিলোপের প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে এই বিধান পরিষদ তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যুক্তফ্রন্টে রাখার ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা রয়েছে। সেটা হল, তখন ফ্রন্টের কর্মসূচি লেখার জন্য যে-কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে ছিলেন- জ্যোতি ভট্টাচার্য, প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং নির্মল বসু। বিধান পরিষদ অপ্রয়োজনীয় এবং তা তুলে দেওয়া উচিত বলে বহু দিন ধরেই নির্মল বসু বলে আসছিলেন, অথচ উনি নিজেই বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন। আর তিনিই তখন মূলত এটা কর্মসূচিতে রাখতে উদ্যোগী হন। বরং জ্যোতি ভট্টাচার্য এতে আপত্তি তুলেছিলেন। তখন আরও কয়েকজন নেতার পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ওটা কর্মসূচিতে রাখা হয়। তবে তাদের মনোভাবটা এমনই ছিল যে- কর্মসূচিতে রাখা হোক, তারপরে না-হয় দেখা যাবে। সেইমতো ৩২ দফা কর্মসূচির ৩১ দফা হিসাবে রাখা হয়েছিল এই বিধান পরিষদ বিলোপের প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ এটা ততটা গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়নি, বরং কিছুটা ‘ক্যাজুয়ালি’ রাখা হয়েছিল। মন্ত্রিসভাতেও যখন প্রস্তাবটি তোলা হয়, সেদিনও একইরকম ক্যাজুয়াল মনোভাব নিয়ে তা পাস করানো হয়। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, রাজ্যে বিধানসভায় বিধান পরিষদ বিলোপের প্রস্তাব পাস হলেও কেন্দ্রীয় সরকার এর বিরোধিতা করবে। কারণ, রাজ্য বিধান পরিষদে বেশিরভাগ সদস্যই তখন কংগ্রেসের। এর ফলে, শেষমেশ বিধান পরিষদ থেকেই যাবে। আর সিপিএম তখন ভেবেছিল, কেন্দ্র এর বিরোধিতা করলে তখন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা যাবে।

এদিকে কার্যক্ষেত্রে একেবারে ভিন্ন ঘটনা ঘটে যায়। রাজ্য কংগ্রেস এ ব্যাপারে তেমন বিরোধিতাই করল না। এমন ঘটনায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে সিপিআই। তখন রাজ্যের মন্ত্রিসভায় সিপিআইয়ের বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন। আর-এক মন্ত্রী রেণু চক্রবর্তী বিধানসভা বা পরিষদ কোনওটারই সদস্য ছিলেন না। ফলে, এই দু’জনকে মন্ত্রী রাখতে গেলে তখন অন্য কোথাও থেকে বিধায়ক করতে হত। এজন্য সিপিআই নেতারা দিল্লিতে গিয়ে তদ্‌বির করেন, যাতে ওই বিল পাস ঝুলে থাকে। অন্যদিকে, সিপিএম আবার এই কাজ ত্বরান্বিত করতে উদ্যোগী হয়।

শেষমেশ বিধান পরিষদ উঠে গেলে সিপিএমের কোনও ক্ষতি হচ্ছিল না, এমন নয়। তাদেরও দুই মন্ত্রী ছিলেন বিধান পরিষদের সদস্য। কিন্তু দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একজন আবদুল্লা রসুলকে মন্ত্রিসভায় রাখা হবে না। অন্যদিকে, অপরজন সত্যপ্রিয় রায়ের জন্য বিকল্প আসনের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। কিন্তু, সিপিআইয়ের পক্ষে বিকল্প ব্যবস্থা করাটা আদৌ সহজ হবে না, সেটা সিপিএম বুঝেছিল। কোনওরকমে বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্য মেদিনীপুরে একটি আসন পাওয়া গেলেও রেণু চক্রবর্তীর জন্য দলীয় কোনও বিধায়ককে পদত্যাগ করাতে পারেনি সিপিআই। ফলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তেই হয়েছিল।

এছাড়া, বিধান পরিষদ বিলোপের ফলে আরও দু’জন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। এঁদের একজন হলেন আরসিপিআইয়ের সুধীন কুমার এবং বলশেভিক পার্টির বরদা মুকুটমণি। এঁরা দু’জনেই না ছিলেন বিধানসভার সদস্য, না বিধান পরিষদের সদস্য। ভাবা হয়েছিল, ভবিষ্যতে পরিষদের সদস্য করে নিয়ে মন্ত্রিত্ব চালিয়ে যাবেন। কিন্তু, বিধান পরিষদ বিলোপের ফলে সেই আশাভঙ্গ হয়। কারণ, কোনও বিধায়ক রাজি হননি তাঁদের জন্য পদত্যাগ করতে।

বহু দিন ধরে বিধান পরিষদ ফেরানোর ভাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এ রাজ্য ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই পুনরায় এই পরিষদ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও, তা বাস্তবায়িত হয়নি। পরে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সময় ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধান পরিষদ গঠনের কথা তোলেন। বয়সজনিত কারণে যাঁদের টিকিট দেওয়া যায়নি, ক্ষমতায় এলে বিধান পরিষদ গঠন করে তাঁদের সেখানে জায়গা করে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ভোটের পর মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেইমতো প্রস্তাব পাস করানো হয়। তবে বিধান পরিষদ গঠনের ফলে এ-রাজ্যে অযথা খরচ বাড়বে বলে বিরোধীরা আগেই আওয়াজ তুলেছিল। বিশেষত, যেখানে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, সেখানে ফের বিধান পরিষদ ফিরিয়ে এনে নতুন করে হাতি পোষা হবে বলে রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তোলে বিরোধীরা।

অন্যদিকে এটাও তো ঠিক, বিধান পরিষদ চাইলেই তো সহজে করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে রাজ্যপাল থেকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশেষত, কেন্দ্রের বর্তমান সরকার তো আদৌ বন্ধুবৎসল সরকার নয়, বরং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বেশ আদায়-কাঁচাকলা সম্পর্ক। ফলে, রাজ্য সরকারের এমন উদ্যোগে তাদের কাছ থেকে আদৌ কতটা ইতিবাচক সাড়া মিলবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
sidmukh12@gmail.com

[আরও পড়ুন: কৃতী ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে রাজনৈতিক বিবৃতির লড়াই? কমরেড, ক’টা কথা ছিল]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement