ভারতে মহিলা ভোটার ৬৬ শতাংশ। অতএব তাদের সমর্থন নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচনে জয় পাওয়া সহজ– এই কথা সমস্ত দলের কাছেই জলের মতো পরিষ্কার। তবে এই মন জুগিয়ে চলার প্রতিযোগিতায় যারপরনাই অবহেলিত নারী ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির দ্বিচারিতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন মিলছে দিল্লির বিধানসভা ভোটে। ভোটারদের মন পেতে যেভাবে বিজেপি আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছে, তা নজিরবিহীন। সদ্য হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে তারা এই প্রতিশ্রুতি বিলির সুফল পেয়েছে। তাই দিল্লিতে তারা একরকম দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কিন্তু অবাক লাগে এটা দেখে যে, কেউ বিজেপিকে এই প্রশ্ন করছে না, ভোটের আগে এই ঢালাও এটা-সেটা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে তো মোদিই ‘রেউড়ি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, এবং দেশের অর্থনীতির পক্ষে বিপজ্জনক আখ্যা দিয়েছিলেন। তাহলে তারা-ই কেন এমন ‘রেউড়ি’ বিলির প্রতিযোগিতায় নামছে?
লোকসভা ভোটে বোঝা গিয়েছে ‘মোদি ম্যাজিক’ ফিকে হচ্ছে। লোকসভার পর কয়েকটি বিধানসভা ভোটে বিজেপির শিক্ষা যে, মোদির মুখ কিছুটা আড়ালে রাখলে ভোটারদের সমর্থন মিলছে। আবার ঝাড়খণ্ডে পরাজয় থেকে বিজেপির এটাও শিক্ষা যে, ‘সাবঅলটার্ন হিন্দুত্ব’-র আবেদন আর সেভাবে কার্যকর নয়। দিল্লি ভোটে বিজেপির প্রচারের অভিমুখ থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, শহর এলাকাতেও ভোটারদের সমর্থন পেতে বিজেপি শুধুমাত্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের আবেগের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। ‘আপ’-এর মতো জনবাদী রাজনীতির প্রবক্তাদের পথেই তারা হঁাটতে আগ্রহী। আপ কোনও আদর্শ বা কর্মসূচিভিত্তিক দল নয়। কিছু জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে সামনে রেখে তারা ভোটের রাজনীতি করে। দিল্লির বিধানসভা ভোটের প্রচারে আপের পাশে বিজেপিকে দেখে মনে হচ্ছে, তারাও এখন হিন্দুত্বর আদর্শ ও কর্মসূচিকে শিকেয় তুলে জনবাদী রাজনীতির অনুশীলনে নেমেছে।
‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা সম্মান যোজনা’-য় রাজ্যের মহিলাদের মাসে ২,১০০ টাকা দেবে বলে ঘোষণা করেছে আপ। অবিলম্বে বিজেপি ঘোষণা করেছে তারা দিল্লিতে সরকার গড়লে মহিলাদের মাসে ২,৫০০ টাকা করে দেবে। দিল্লির ভোটে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ফলে দিল্লির মহিলারা বিরাট স্বস্তিতে। এছাড়াও বিজেপি ঘোষণা করেছে, সরকারে এলে দিল্লির সব অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে ২১ হাজার টাকা, ৬টি পুষ্টিকর খাবারের প্যাকেট, প্রথম সন্তানের জন্য ৫,০০০ টাকা এবং দ্বিতীয় সন্তানের জন্য ৬০০০ টাকা করে দেওয়া হবে ও পরিবারের মহিলা সদস্যদের মাসে একটি করে ৫০০ টাকায় রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার। অর্থাৎ, প্রতিশ্রুতি বিলিতে আপ-কে ছাপিয়ে গিয়েছে বিজেপি। সেই কারণে আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল দাবি তুলেছেন, মোদিকে ‘রেউড়ি’ কটাক্ষের জন্য এখন ভোটারদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
মোদি তঁার ‘রেউড়ি’ কটাক্ষের জন্য মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের সময় ক্ষমা চাননি যখন, তখন দিল্লি ভোটের আগে ক্ষমা চাইবেন, এমন ভাবা অবাস্তব। মহারাষ্ট্রে বিজেপি জোটের ‘মুখ্যমন্ত্রী মাঝি লড়কি বহিন যোজনা’ নিয়ে যথেষ্ট চর্চা হয়েছে। এই প্রকল্পে এখন রাজ্যের মহিলাদের মাসে ১,৫০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেবেন্দ্র ফড়নবিশের সরকার শুরুতেই তালিকা থেকে কুড়ি লক্ষ নাম বাদ দেওয়ায় বিতর্কও হচ্ছে। কারণ, এই কুড়ি লক্ষ মহিলা অন্য সরকারি প্রকল্পে উপকৃত। এই ঘটনায় একটি বার্তা পরিষ্কার, বিজেপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ভোট। নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের মাধ্যমে তারা মহিলাদের ক্ষমতায়ন চাইছে না। তাই ভোটের পর নানা অজুহাতে কিছু নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রয়াস।
মহিলা ভোটারদের এখন ‘গেম চেঞ্জার ব্লক’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। মহিলাদের মধে্য যে ভোটদান করার অাগ্রহ বাড়ছে, তা বুথের লম্বা লাইন দেখলেই টের পাওয়া যায়। গোটা দেশের নিরিখে যে-হিসাব পাওয়া যায়, তাতে মহিলা ভোটারদের ৬৬ শতাংশই এখন ভোট দেয়। পুরুষ ভোটারদের ক্ষেত্রেও এটাই ভোটদানের গড় হার। অতএব মহিলা ভোটারদের একটি বড় অংশের সমর্থন নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচনে জয় পাওয়া সহজ।
তবে মহিলা ভোটারদের খুশি করতে ভোটের অাগে নগদ হস্তান্তরের মতো প্রকল্প ঘোষণা যেমন কাম্য নয়, তেমন ভোট মিটলেই প্রকল্প নিয়ে নানারকম টালবাহানা নিন্দনীয়। মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেটা ঘটছে। একই দোষে দুষ্ট কংগ্রেসও। কিছু দিন অাগে কর্নাটকের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের জেতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ‘গৃহলক্ষ্মী’ প্রকল্পর। এই প্রকল্পে যেসব মহিলা শুধু বাড়ির কাজ করে, তাদের মাসে ২,০০০ টাকা করে দেওয়া হয়। অথচ এই কর্নাটকেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা ধর্মঘট করছে তাদের ভাতা ১,০০০ টাকা থেকে বাড়ানোর দাবিতে। অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজে্যও একই অবস্থা। কোথাও ‘অাশা’ ও ‘অঙ্গনওয়াড়ি’ কর্মীদের ভাতা বাড়ে না। মিড ডে মিল-এ কর্মরত মহিলাদের মজুরি বৃদ্ধি হয় না। সামান্য মাসিক এক-দেড় হাজার টাকা ভাতা বা মজুরিতে তাদের কাজ করতে হয়। সেসব নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি উদাসীন। কিন্তু ভোট এলেই মহিলাদের জন্য নানারকম নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের বন্যা বয়। এইসব প্রকল্পে টাকার পরিমাণ প্রতিযোগিতা করে বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে কর্মরত মহিলাদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি করা, তাদের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থার বিষয়ে কারও হুঁশ নেই।
এর মধে্য ব্যতিক্রম অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজে্যর মুখ্যমন্ত্রী অাশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ভাতা বাড়ানোর জন্য সবসময় সচেষ্ট। সম্প্রতি মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন রাজে্য সমস্ত ‘অাশা’ ও ‘অাইসিডিএস’ কর্মীদের স্মার্টফোন দেওয়া হবে। রাজে্য এ-বছর কোনও ভোট নেই, তবুও এই অংশের মহিলাদের জন্য এই কর্মসূচি নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ ছাড়াও নারী ক্ষমতায়নের জন্য তঁার সরকারের ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’ ইত্যাদি নানা প্রকল্প রয়েছে। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পেও এ-রাজে্য পরিবারের প্রধান মহিলা সদসে্যর নামে কার্ড হয়। এ-রাজে্য ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে মহিলারা যথেষ্ট সংখ্যায় কাজ পায়।
ভোটের জন্য মহিলাদের মন জেতার প্রতিযোগিতা বন্ধ করে নারী ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের জন্য সুচিন্তিত প্রকল্প গ্রহণ করতে পারলে সার্বিক সামাজিক অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী একেকটি রাজে্যর ভোটের অাগে এই খয়রাতি বিলির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লে তা উদ্বেগের হয়। কারণ এর তো কোনও সীমা নেই। এই প্রতিযোগিতা থামাতে হয়তো দেখা যাবে কোনদিন দেশের শীর্ষ অাদালতকেই হস্তক্ষেপ করতে হল।
