শম্পালী মৌলিক: পঞ্চমীর ভিড় উজিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবি দেখতে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহ প্রায় ভরতি পেলাম। বুঝলাম দুই হেভিওয়েট তারকার যুগলবন্দির অমোঘ আকর্ষণ। সেই আকর্ষণ প্রায় সোয়া দু’ঘণ্টার ছবিটি ধরে রাখতে পারে কি না দেখার ছিল। উত্তর হিসেবে যা পেলাম তা হল আলোয় মোড়া শহরে, আঁধার-ঘন জীবনের গল্প বলতে গিয়ে শেষ অবধি রোদ-ঝিলমিল স্বপ্নটা যে ছোঁয়া যায়, সেই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে দু’টো মানুষ। ফলে সব শেষে খুশির বাতাস মন ভাল করে দেয়। রক্তের সম্পর্কের বাইরে যে ‘কাছের মানুষ’ (Kacher Manush) খুঁজে পাওয়া যায় এই ছবি সে কথা বলে।
শুরুতেই বোঝা যায় অর্থ-ই সমস্ত অনর্থের মূলে। তাই অর্থের অভাব কী চরম পরিণতি আনে সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবনে তার বাস্তব-ছোঁয়া পরিস্থিতি দেখি ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র কুন্তলের (দেব) জীবনে। কর্মহীন ছেলেটি একসময় অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করত। চিটফান্ডে টাকা লাগিয়ে প্রতারিত হয়েছে। তার ভাই বাবাই চিটফান্ডের এজেন্ট ছিল। ফলে সকাল-বিকেল বাড়িতে পাওনাদার কড়া নাড়ত। বাবা নেই তাদের। একদিন তর্কের মধ্যে ভাইকে চড় মারে কুন্তল। মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে ভাই আত্মহত্যা করে বসে। তারপর মায়ের সেরিব্রাল এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। এবার কুন্তল কী করবে? এত ঋণ, জীবনধারণের খরচ, মায়ের চিকিৎসা কীভাবে সামলাবে?
[আরও পড়ুন: মণিরত্নমের নিখুঁত পরিচালনায় ঐশ্বর্য রাই বচ্চনের দুর্দান্ত অভিনয়, ‘পোন্নিয়্যান সেলভান’ অবশ্যই দেখুন]
আমরা এখন প্রায়ই দেখি কর্মহীন মানুষের জীবন কেমনভাবে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, অফিসে অফিসে ঘুরেও চাকরি জোটে না, তারই তীব্র অভিঘাত এই ছবি জুড়ে। এমন সময় কুন্তলের দেখা হয় জীবনবিমা কোম্পানির এক এজেন্ট সুদর্শনের (প্রসেনজিৎ) সঙ্গে। কুন্তল যখন রেললাইনে আত্মহত্যা করতে চায়, লোকটা আটকায় তাকে। লোকটা যে ততটা সাদামাটা নয় স্পষ্ট বোঝা যায়। শুরুতেই কুড়ি টাকা ধার চায়। সে কুন্তলকে বলে, মরবেই যখন একটা পলিসি করে মরো। সেক্ষেত্রে পলিসির টাকায় মায়ের জীবনটা তো বাঁচবে। ওদিকে সুদর্শনের অর্থাভাবও চরমে। লোকের প্রিমিয়ামের টাকা মারার দুর্নামও আছে। তার বাড়িতেও অসুখের করাল ছায়া। দারিদ্র-নিপীড়িত এই দু’টো মানুষ পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সুদর্শন একটা একটা করে উপায় বার করে কুন্তলের মৃত্যুর জন্য, খোঁজে তার আকস্মিক দুর্ঘটনা-স্থল। এতে কুন্তলের সঙ্গে তার স্বার্থও যে জড়িয়ে।
এর মধ্যেই আলোর (ইশা) মতো মিষ্টি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় কুন্তলের। সহজেই ভালবাসা ডানা মেলে। কিন্তু কুন্তল তো জীবনের দিকে এগোলে বিমার টাকা আসবে না, তাকে তো মৃত্যুর পথে হাঁটতে হবে! বিমা এজেন্ট তাকে মরণের যাত্রায় চালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। অন্যদিকে খুশিয়াল মেয়েটা তাকে তীব্রভাবে জীবনের দিকে টেনে রাখে। এ যেন ট্র্যাপিজের খেলা। আত্মহত্যা না বেঁচে থাকা? সুদর্শন লোকটা ভাল, না বেশ খারাপ? কুন্তল পারবে ঘুরে দাঁড়াতে, না কি ডুবে যাবে? শেষপর্যন্ত আলো কি জ্বলে থাকবে কুন্তলের জন্য? বেশ লাগে দেখতে। তবে মাঝে মাঝেই ছবির গতি রুদ্ধ করেছে গান।
‘চুম্বক মন’ আর ‘যদি ভালবাস আমায় মুক্তি দাও’ গান দু’টো ছবির মেজাজের সঙ্গে মানানসই হলেও, গানের সংখ্যা কম হলে ছবির পক্ষে ভাল হত। পরিচালক পথিকৃৎ বসু খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে যে বেশ ভেবেছেন, তা ‘কাছের মানুষ’ দেখলে বোঝা যায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিটিকে অনুপকুমার-বিকাশ রায় অভিনীত ‘জীবন কাহিনী’র প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। গল্পের বিন্যাসে অনেক তফাত যদিও। দ্বিতীয়ার্ধ একটু শ্লথ লাগে। তবে বিনোদনের সমস্ত উপাদান থাকায় এ ছবি শেষ অবধি মনোযোগ ধরে রাখে।
এবার আসি অভিনয়ের প্রসঙ্গে, সুদর্শনের মতো ধূসর চরিত্রের ডায়মেনশন দারুণভাবে পর্দায় তুলে এনেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (Prasenjit Chatterjee)। দেবকে (Dev) বেশ ভাল লাগে কারণ তাঁর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রসেনজিতের সঙ্গে সমানে-সমানে লড়ে গিয়েছেন। এই দুই মহাতারকার মাঝে ভোরের শিউলি ফুলের মতো ইশা সাহা (Ishaa Saha)। প্রতিটি শটে তাঁর নিখুঁত অভিব্যক্তি মন ছুঁয়ে যায়। ছোট্ট চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিক চমৎকার। মায়ের ভূমিকায় তুলিকা বসুও যথাযথ। সবমিলিয়ে কাছের মানুষকে নিয়ে দেখার ছবি, হাল না ছেড়ে জীবনে ফেরার ছবি এটা।
সিনেমা- কাছের মানুষ
অভিনয় -প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়,দেব, ইশা সাহা, সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, তুলিকা বসু, রঞ্জিত মল্লিক
পরিচালনা- পথিকৃৎ বসু