বিশ্বদীপ দে: কুয়াশা কেবল পাহাড়ে থাকে না। মানুষের জীবনেও ঘনায়। তখন সেই কুয়াশা কেটে রোদ ওঠার অপেক্ষাতেই দিন কাটে। সিঙ্গল মাদার মায়া ডিস্যুজাও স্বপ্ন দেখেছিল অতীতের কুয়াশা থেকে মুক্তি পেয়ে কিশোরী মেয়ের সঙ্গে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার। তা গড়ে উঠছিলও। কিন্তু আচমকাই কালিম্পংয়ে হাজির হয় এক আগন্তুক। যার আবির্ভাবে ফের নতুন করে কুয়াশা ঘনায়। একটি মৃত্যু ও তাকে ঘিরে বাড়তে থাকা কুয়াশার ভিতরে দমবন্ধ অবস্থা থেকে কি পরিত্রাণ পাবে মায়া? সেই গল্পই বলে পরিচালক সুজয় ঘোষের ‘জানে জান’। ট্রেলার ঘিরে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। ছবি কি তা পূরণ করতে পারল?
জাপানি উপন্যাস ‘দ্য ডিভোশন অফ সাসপেক্ট X’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘জানে জান’ (Jaane Jaan)। এই উপন্যাস অবলম্বনে জাপানে ছবি হয়েছে। এদেশেও তৈরি হয়েছে ‘দৃশ্যম’-এর মতো ছবি, যেখানে ছত্রে ছত্রে রয়েছে উপন্যাসটির ছায়া। কিন্তু সম্পূর্ণ উপন্যাসটি অবলম্বনে হিন্দি ছবি এই প্রথম। নেটফ্লিক্সের জন্য তৈরি ছবিটিতে মায়ার ভূমিকায় রয়েছেন করিনা কাপুর খান (Kareena Kapoor Khan)। ছবির অন্য দুই প্রধান চরিত্র স্কুল শিক্ষক নরেন (জয়দীপ অহল্বাত) ও পুলিশ অফিসার করণ (বিজয় বর্মা)। বিজয় (Vijay Varma) ও করিনা দুজনেই চমৎকার কাজ করেছেন। ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রে সৌরভ সচদেবা যথাযথ। কিন্তু সকলের নজর যেন কেড়ে নেন জয়দীপই। স্কুল শিক্ষক অন্তর্মুখী এক মানুষের ভূমিকায় তিনি অনবদ্য।
[আরও পড়ুন: ‘বেশি জল নয় তামিলনাড়ুকে’, কাবেরী বিতর্কে ২৬ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরু বনধের ডাক]
‘দৃশ্যম’ ছবির কথা আগেই বলা হয়েছে। সকলেই জানেন, সেই ছবি আসলে একটি খুনের পর অপরাধীদের পরিত্রাণ পাওয়ার কৌশলের গল্প। ‘জানে জান’ও একটি খুনকে ঘিরেই পাক খায়। ছবির মোটামুটি শুরুর দিকেই সেই খুনটি হয়। তারপর থেকে গল্প গড়ায় সেই খুনকে কেন্দ্র করে। শেষ পর্যন্ত কি অপরাধী বাঁচতে পারে? নাকি ধরা পড়ে যায় পুলিশি তদন্তের প্যাঁচে? সেটুকু উহ্য রাখতেই হবে। কেবল এটা বলা যায়, এই ছবির শেষটা আর পাঁচটা থ্রিলারের মতো নয়। হয়তো কারও কারও হতাশ লাগবে। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, ক্লাইম্যাক্সের এই পরিণতিই হয়তো যথার্থ। তাতে নিছক চোর-খুনি খেলাকে অতিক্রম করে যায় কাহিনির অভিমুখ।
কিন্তু তবুও একথা মানতেই হবে সুজয় ঘোষের (Sujoy Ghosh) যে ব্রিলিয়ান্স ‘কাহানি’তে ছিল, তা যেন আর ফিরে আসছে না। ‘অনুকূল’ অবশ্য শর্ট ফিল্ম হিসেবে চমৎকার নির্মাণ ছিল। কিন্তু ‘জানে জান’ তেমন হতে পারেনি। অথচ সম্ভাবনা ছিল। একথা সত্যি, জয়দীপের চরিত্রটিকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে নির্মাণ করা হয়েছে। অন্তর্মুখী একজন মানুষ, যার সারা জীবন জুড়ে কেবলই অঙ্ক, তাকে তৈরি করা সহজ ছিল না। নরেনকে জীবন্ত করে তুলেছেন জয়দেব। কিন্তু এর পিছনে অবশ্যই ছিল পরিচালকের মস্তিষ্ক। কিন্তু নরেনের মতো যত্ন মায়া বা করণ পায়নি। করিনা কিংবা বিজয় তাঁদের যথাসাধ্য করেছেন। কিন্তু যেটুকু খামতি থেকে যায় তা চিত্রনাট্যের জন্যই। বিশেষ করে মায়ার সঙ্গে তার কিশোরী মেয়ের রসায়ন আরও একটু ভালো করে দেখালে দর্শক আরও ইনভলভড হতে পারত। পাশাপাশি প্রশ্ন জাগে, ছবিতে কেন কুয়াশা কিংবা রোদে ঝলমল পাহাড়কে আরও একটু দেখানো হল না। এটা ঠিকই ক্রাইম থ্রিলারে সেই অবকাশ কমই থাকে। তবুও ঘটনার ঘনঘটাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারত পাহাড়ের প্রকৃতিই।
[আরও পড়ুন: রাজস্থান বিধানসভায় আদৌ জিতবে কংগ্রেস? সংশয়ে খোদ রাহুল গান্ধীই]
তবে সব মিলিয়ে ছবিটি একবার দেখতে ভালোই লাগে। শুরু করলে পুরোটা দেখতে ইচ্ছে করে। সব সময় একটা কী হয় কী হয় ভাব বজায় রাখতে পেরেছেন পরিচালক। অ্যাকশন ও সাসপেন্সের মিশেলও সুন্দর। চিত্রনাট্য চরিত্রের বুননে সব ক্ষেত্রে যত্নশীল না হলেও কাহিনি বর্ণনায় মসৃণতা বজায় থাকে আগাগোড়াই। কেবল শেষের জার্কটুকু ছা়ড়া। তবে সেটা হয়তো ছবিটিকে একটা অন্য মাত্রা দেয়। ছবি শেষ করার পরও সেটা মাথার ভিতরে চলতে থাকে। সাধারণত থ্রিলারের ক্ষেত্রে এমন প্রাপ্তি কমই হয়। এর জন্য সুজয় ঘোষকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।