নবনীতা: তখন সবে সকাল হচ্ছে৷ ঝিঁঝি পোকার কনসার্ট শুনতে শুনতে এগিয়ে চলা৷ পাহাড়ি এলাকায় দিনের বেলাতেও ঝিঁঝি পোকার ডাক নতুন কোনও ব্যাপার নয়৷ এছাড়া চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ৷ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়িতে করে বীরপাড়া থেকে তখন গারুচিরার দিকে এগোচ্ছি৷ পাহাড়গুলোর মাথায় সাদা মেঘের ঘোমটা যেন সযত্নে কেউ টেনে দিয়েছে৷ ঘন জঙ্গলে পাতা, পথের নুড়ি-পাথর, ঘাস সব চুপচুপে ভেজা৷ নিজেরা বলাবলি করছিলাম বৃষ্টি হয়েছে মনে হয়৷ ড্রাইভার রাজেশ মুখ থেকে কথা কেড়ে বললেন-না, না শিশির পড়ে ভিজে রয়েছে৷
রাজেশই বললেন, “গাড়ি থেকে নেমে একটু বাতাসটা নিন৷ থ্যাঙ্কস টু রাজেশ৷ সে এক অদ্ভুত মাদকতা৷ রাজেশের সতর্কবাণীটাও ফেলার নয়৷ পুরো এলাকাটা হাতির সাম্রাজ্য৷ তাই এদিক ওদিক সকলেই খেয়াল রাখছিলাম৷ কখন শুঁড় উঁচিয়ে এগিয়ে আসে৷ পাগলা হাতি হলে তো পোয়াবারো৷ অমন এক নিস্তব্ধতার শ্বাস নিতে নিতেই শুনলাম ঘণ্টার আওয়াজ৷ মনে হচ্ছে কে যেন সজোরে ঘণ্টা বাজাচ্ছে৷ রাজেশ বললেন “এটা ঘণ্টা পোকার ডাক”৷ গোটা ডুয়ার্সের জঙ্গল জুড়ে শোনা যায় এই ঘণ্টা পোকার কনসার্ট৷ শাল, সেগুনের মাঝখান দিয়ে এগোতে লাগলাম৷ শিরশিরে বাতাসে গায়ে শিহরন জাগে৷ ভয় লাগলেও মোলাকাত করার ষোলোআনা ইচ্ছে হাতি, বাইসন, শম্বরদের সঙ্গে৷ জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছলাম ‘গারুচিরা’৷ ডুয়ার্স ভ্রমণের ভার্জিন স্পষ্ট বলা যায় একে৷ খুব বেশি লোকের ভিড়-ভাট্টা এখনও শুরু হয়নি৷ গারুচিরা হল ভারত ও ভুটান বর্ডার সংলগ্ন অসাধারণ এক ফরেস্ট ভিলেজ৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভুটান পাহাড় আর তরাই অঞ্চল৷ নেপালের হাতিদের ডুয়ার্সে প্রবেশের প্রধান ফটক এই গারুচিরা৷
জঙ্গল, পাহাড়, নদী, চা-বাগান, বাহারি ফুলের বাগানের জমজমাট প্রেমই গারুচিরার আকর্ষণ৷ ছড়ানো ছিটানো কাঠের বাড়িগুলিও দেখার মতো৷ পাহাড়ি নদী সুকৃতির ধারে পড়ে থাকা পাথরের উপরে বসে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ প্রকৃতি তার আপন খেয়ালেই নদীর পাড়ে তৈরি করে বসে আছে ন্যাচারাল সল্টলেক৷ বন্যপ্রাণীদের তাই অবাধ আনাগোনা এই চত্বরে৷ নুন চেটে খাওয়ার সে কি হিড়িক৷ সে এক অদ্ভুত দৃশ্য৷ নুন, তাও নাকি চেটে খেতে হয়৷ স্থানীয়দের মুখ থেকেই শুনলাম এমন একটা সময় ছিল যখন গারুচিরার মানুষেরা জীবন ধারণের তাগিদে ও অভাবের তাড়নায় জড়িয়ে পড়তেন নানারকম অপরাধমূলক কাজে৷ কেউ করতেন কাঠ পাচারের কাজ আবার কেউ জড়িয়ে পড়তেন চোরাই কারবারে৷ বন দফতরের উদ্যোগে তাঁদের জীবনের মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷ গারুচিরায় তাই গড়ে উঠেছে ইকো-টুরিজম৷ গ্রামবাসীদেরই নিযুক্ত করা হয় সেই প্রকল্পে৷ গ্রামবাসীদের যত্নে লালিত গারুচিরার বন বাংলো৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর জঙ্গলের রোমাঞ্চে ঘেরা ডুয়ার্সের গারুচিরা রূপে-গুণে অতুলনীয়৷ ভাললাগা আর শরীরকে চাঙ্গা করে নেওয়ার জন্য আদর্শ স্পট এই গারুচিরা৷ এই গরমে শহর ছেড়ে একটু ঠান্ডার আবেশ নিতে দিন তিন-চারেকের জন্য ঘুরে আসুন গারুচিরা ফরেস্ট৷ এক অনাবিল আনন্দ সঙ্গে নিয়ে ফিরবেনই ফিরবেন৷
যেতে হবে–বর্ষা এড়িয়ে৷
থাকা যাবে–গারুচিরা ভিলেজ ইকোর টুরিজম, বান্দাপানি জলপাইগুড়ি ডিভিশন৷ (ঠিকানা, ফোন নম্বরের জন্য গুগল দেখুন)৷
ঘর ভাড়া-৬০০ টাকার মতো৷ খাওয়ার খরচ ২০০-৩০০-র মধ্যে৷ গাইড নেবেন ১০০-২০০ টাকায়৷
কী ভাবে যাবেন–শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল, পদাতিক এক্সপ্রেস (বৃহস্পতিবার ছাড়ে না), কাঞ্চনজঙঘা এক্সপ্রেস, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে নিউ জলপাইগুড়ি৷ সেখান থেকে গাড়িতে বীরপাড়া হয়ে গারুচিরা৷ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গারুচিরা যেতে গাড়ি ভাড়া ২০০০ টাকা৷
The post ঘণ্টা পোকার কনসার্ট আর হাতিদের সাম্রাজ্যে appeared first on Sangbad Pratidin.