সেনসেক্সের উত্থান-পতন আজকাল আর তেমন অবাক করে না, যেমনটা আগে করত। এমনকী, একদিনে ৫০০ পয়েন্টের ওঠানামাও অধুনা বাজারের জন্য তেমন কোনও বড় খবর নয়। তবে লগ্নিকারীরা এ কথা নিশ্চিতভাবেই জানেন, যে বেশি উপরে উঠতে গেলে পতন অনিবার্যই। ঠিক এই ভিত্তিতেই বাজার বিভক্ত আমরা-ওরায়। একদলের আশা, সূচক আরও বাড়বে। আর অপর দল তাল ঠুকছেন ঠিক বিপরীত লয়ে। প্রত্যেকের কাছেই নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। তা কে কী ভাবছেন, আর কোন মাপকাঠিতে মেপে কী পূর্বাভাস করছেন, বিশ্লেষণধর্মী এই লেখায় সব দিকই তুলে ধরলেন নীলাঞ্জন দে
একদিনে ৫০০ পয়েন্ট ওঠাপড়া ইদানীং সেনসেক্সের পক্ষে জলভাত হয়ে গিয়েছে, মার্কেটের পক্ষে এ আর তেমন বড় খবর নয়। বস্তুত, স্টক মার্কেট যে বাড়-বৃদ্ধি সাম্প্রতিক অতীতে দেখিয়েছে, তার জন্য বেশ কিছু কারণ দায়ী। লগ্নিকারীরা সেই সমস্ত কারণগুলি বিলক্ষণ জানেন। তাঁরা অবশ্য এ-ও জানেন যে বেশি উপরে উঠলে পতন অনিবার্য হয় – তবে সেই পতন কবে আসবে তা কেউ সঠিক জানেন না। খুব স্বাভাবিকভাবেই, মার্কেটে দু’টি বিপরীত শ্রেণির মতাবলম্বী বিনিয়োগকারী এই মুহূর্তে প্রবলভাবে উপস্থিত। প্রথম দল ভাবছেন যে সূচক আরও বাড়বে, দ্বিতীয় দল আবার উল্টোটাই ভাবছেন। আমরা বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি এই দুই মতবাদ নিয়ে। ফান্ড ম্যানেজার, ওয়েলথ অ্যাডভাইসার এবং অবশ্যই লগ্নিকারীরা- সকলেই নিজস্ব নিজস্ব কারণ দর্শিয়েছেন। আজ আমাদের প্রতিবেদন এই নিয়েই। মূল বিষয়টিকে ‘পক্ষে’ এবং ‘বিপক্ষে’- দু’ভাবে ভাগ করেছি আমরা।
পক্ষে–
এক কথায়, লিকুইডিটি – অর্থাৎ প্রভূত পরিমাণে টাকা মার্কেটে আসছে, বহু ধরনের স্টকে সেই বিপুল অর্থরাশি বিনিয়োগ হয়ে চলেছে এবং দাম বাড়ছে। বিদেশি উৎস তো বটেই, এই টাকার ‘ইনফ্লো’র জন্য দেশি ইনভেস্টররাও দায়ী। এক বৃহৎ অংশ অবশ্যই পুরনো ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুণ। ডিপোজিটের সনাতনি বিনিয়োগ আর তেমন প্রাসঙ্গিক নয় বলেই মনে করা হচ্ছে, এবং কম সুদের জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীও যে আর উৎসাহী নন সে কথা তো ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।
[আরও পড়ুন: বাড়ছে ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা, সুরক্ষিত থাকতে জেনে নিন এই তথ্যগুলি]
অতএব ডিপোজিটের ভাগ কমে গিয়ে ইকুইটিতে বেশি অ্যালোকেশন তো হচ্ছেই। সরাসরি বা ইকুইটি ফান্ডের মাধ্যমে, দু’ভাবেই নতুন লগ্নি স্টক মার্কেটে পৌঁছচ্ছে। হ্যাঁ সমস্ত ধরনের ম্যাক্রো ইকনমিক ফ্যাক্টরস এই বৃদ্ধির হার আরও জোরদার করছে না বটে, তবে তাতে শেয়ার বাজারের উপর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না। বরং মার্কেট এই ভেবে আশান্বিত যে, অনেক IPO (এবং NFO-ও বটে) আগামিদিনে আসতে চলেছে। কাজেই নতুন টাকার যোগান যে থাকবেই, সে ব্যাপারেও অনেকে নিশ্চয়তা বোধ করছেন। প্রসঙ্গত, মার্কেট নিয়ন্ত্রক সেবির প্রকাশিত IPO-র তালিকা বেশ লম্বা চওড়া। অনেক ছোটবড় ইস্যুয়ার আছে সেখানে, আছে লাইফ ইনসিওরেন্স কর্পোরেশনও- যে ইস্যুটি নিয়ে মার্কেটে ইতিমধ্যে অনেকেই সরব হয়েছেন।
লগ্নিকারীদের একাংশ বিশ্বাস করেন যে সাময়িক বিচ্যুতি ঘটলেও বাজারের অভিমুখ ঊর্ধ্বগামীই থাকবে। কবে সূচক ৬০,০০০ পেরিয়ে আরও উত্তরে যাবে তা নিয়ে আমরা জল্পনা-কল্পনা করব না বটে, তবে নানা সম্ভাবনার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিপক্ষে–
সম্ভাবনা যাই হোক, উল্টোদিকের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে বইকি। তার কারণ মার্কেটের বিপক্ষে একাধিক বড় ফ্যাক্টর কাজ করছে, সেগুলির সম্মিলিত শক্তি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। প্রথমেই বলি সেই ম্যাক্রো ফ্যাক্টরগুলির কথা – যেটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনীতির বাড়বৃদ্ধি তেমন নেই, এবং প্রোডাকশন সূচক নিচের দিকেই বিরাজমান। গ্রোথই যদি ভালভাবে না হয় তাহলে এতবড় দেশে (চাহিদার বাড়া সত্বেও) অনেকের আশাই বিনষ্ট হবে।
তবে মার্কেটের বিপক্ষে যে বিষয়টি প্রবলভাবে কাজ করছে, তা ইনফ্লেশন – মুদ্রাস্ফীতির প্রবল চাপ যে আছে তা তো খুব স্পষ্ট। কমোডিটির ক্ষেত্রে দাম বাড়ার অভিঘাত বহু ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করবে। মনে রাখবেন খনিজ তেল এবং অন্য কমোডিটির দাম এতটাই বাড়ছে যে অনেক সাধারণ মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ওষুধপত্র, মেডিকাল পরিষেবা, হেলথ ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম, নানা ধরনের জ্বালানির দাম এবং সর্বোপরি খাদ্যবস্তুর দাম ভালই বেড়েছে। রিজার্ভ ব্যংক অবশ্য সুদের হার এখনই বাড়াচ্ছে না বলেই ইঙ্গিত করেছে – তবে আগামিদিনে কি ঘটবে তা নিশ্চয়ভাবে বলা যায় না।
আরও একটি কথা। আমেরিকায় শীঘ্রই সুদের হার বাড়বে, সে দেশের ব্যংক নিয়ন্ত্রক, ফেডেরাল রিজার্ভ সেই রকমই ইঙ্গিত করেছে। ফলত, বেশ কিছু টাকা ভারতবর্ষের মতো দেশের মার্কেট থেকে বেরিয়ে আমেরিকায় যাবে স্বাভাবিকভাবেই। আমাদের জন্য এটি খুব গুরুতর এক বিষয়। তাও বলে রাখা ভাল এখনই এ নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা সম্ভবপর নয়। সম্ভাবনা আছে, এইটুকুই জানানো ভাল। এছাড়াও বলা উচিত যে, চাইনিজ মার্কেটে ইদানিং অনভিপ্রেত ঘটনা লক্ষ্য করা গিয়েছে, সেরকম আবার হলে মুশকিল।
তাহলে যদি ছোট একটি তুলনামূলক তালিকা চটজলদি তৈরি করা যায়, চিত্রটি এই রকম হবে –
ইন্টারেস্ট রেটের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। অনেকের মতে রিজার্ভ ব্যংক ঠিকই করছে সুদ না বাড়িয়ে। কর্পোরেট সেক্টরে সুদজনিত খরচ বেড়ে যাবে যদি রেট বৃদ্ধি পায়। এই মুহূর্তে ব্যংক নানা সেক্টরের জন্য আরও টাকা দিতে রাজি – আমরা ইতিমধ্যে টেলিকম ইত্যাদির ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা দেখেছি। এছাড়াও বলা ভাল, করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। সরকারও কয়েকটি পলিসিগত ‘রিফর্ম’ আনার জন্য সচেষ্ট হয়েছে বলেই মনে হয়। ব্যাড ব্যাংকের স্থাপনা করা এবং ন্যাশনাল অ্যাসেট মনেটাইজেশন পরিকল্পনার কথা উদাহরণ হিসাবে তুলে
আনা যায়।
আগামিদিনে ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নির সম্ভাবনা বিপুল। ইনসিওরেন্স এবং মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানিগুলি প্রচুর বিনিয়োগ পাচ্ছে, এবং এই টাকার এক বিরাট অংশ স্টক মার্কেটেই প্রবেশ করবে, ধরে নেওয়া যায়। হয়তো লিকুইডিটিতে ভাঁটা পড়বে না তেমনভাবে, এবং এই ধারণাই ভারতীয় বাজারকে দৃঢ়তর করে তুলবে। তা অবশ্যই সুচকে প্রতিফলিত হবে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র।