বিশ্বদীপ দে: মাননীয় শাহরুখ খান,
তিন দশকেরও বেশি সময় আগে একটি বাইকে চেপে আপনার রুপোলি পর্দায় আবির্ভাবের সময় আমরা একটা অন্য পৃথিবীতে বাস করতাম। অন্ধকার হলে হিরোর এন্ট্রিতে সিটি পড়ত, উড়ত পয়সা। আপনিও সেই ‘দিওয়ানা’ ছবি থেকেই দর্শকের কাছ থেকে তথাকথিত ‘কুর্নিশ’ পেতে শুরু করেন। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে ওঠেন অপরাজেয় সুপারস্টার। তারপর মেগাস্টারও। কিন্তু এই ২০২৩ সালের পৃথিবীতে, যখন বিনোদন ব্যাপারটাই তার রূপরেখা বদলে ফেলেছে, আপনিও প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কি আর টিকে আছে তেমন ম্যাজিক? লোকে কি কেবল একজন হিরো ‘জিন্দা হ্যায়’ কিনা জানতে হলমুখী হবে? গোটা দেশের বিনোদন দুনিয়া সেদিকেই তাকিয়ে ছিল।
এই পরিস্থিতিতে হলে বসে টের পেলাম বাইরের দুনিয়া বদলেছে বিস্তর, কিন্তু অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের অতিকায় পর্দায় আজও শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan) নামের এক ব্র্যান্ড অনতিক্রম্য হয়ে রয়ে গিয়েছে। ‘পাঠান’ যশরাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্পাইভার্সের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট হতে পারে। কিন্তু তারও আগে এটা আপনার কামব্যাকের ছবি। একটা লোক লাগাতার ব্যর্থতা, বিতর্ক আর লোয়ার ব্যাক পেইন সামলে ফিরতে পারবে কি? সকলের ফোকাস আসলে ছিল সেদিকেই। সিনেমা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই আভাস মেলে, হ্যাঁ, পাঠানের মতোই ‘জিন্দা হ্যায়’ আপনার ম্যাজিক।
[আরও পড়ুন: দেশজুড়ে মুক্তি পেল ‘পাঠান’, তার আগেই অনলাইনে ফাঁস শাহরুখের কামব্যাক ছবি!]
কিন্তু কেবল ম্যাজিকেই তো সাফল্য আসে না। লোকে একটা দুটো দৃশ্যে আপনাকে দেখবে। তারপর খুঁজবে গল্প। না হলে আপনার ক্যারিশমা সত্ত্বেও পরপর এতগুলি ছবি মুখ থুবড়ে পড়ত না। আপনার এর আগের ছবি ‘জিরো’তে যা ঘটেছিল। ‘পাঠান’ (Pathaan) তৈরির সময় একথা নিশ্চয়ই আপনার এবং পরিচালকের মাথায় ছিল। তাই এই ছবির গল্পে সবরকম উপাদান নিপুণ ভাবে মেশাতে কসুর করেননি। একটা বাণিজ্যিক ছবি যে যে কারণে হিট হয়, সবই রয়েছে এই ছবিতে। চলতি কথায় ‘ফুল প্যাকেজ’। টিজার ও ট্রেলার থেকেই বোঝা গিয়েছিল গল্পের গরু মহাকাশে পৌঁছবে। তাই পৌঁছেছে। কিন্তু এমন একটা ছবি কি সেই অসম্ভবের সীমা পেরনো উড়ানই দাবি করছিল না?
প্রথম দৃশ্য থেকেই দুদ্দাড়িয়ে এগোতে থাকে ছবির গল্প। কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্দায় আপনি। যেমনটা দেখা গিয়েছিল টিজারে। রক্তস্নাত, আহত কিন্তু অবসৃত নন। ততক্ষণে পরিচালক ছবির গল্প চড়া মাত্রায় বেঁধে দিয়েছেন। কিছুই আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। জন আব্রাহাম ও দীপিকাও আপনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্ক্রিন মাতাচ্ছেন। চিত্রনাট্য কেবল শাহরুখকে জায়গা দিয়েছে, এই বদনাম আপনার ঘোর সমালোচকও দিতে পারবেন না। হাততালি পাওয়ার মতো সংলাপ অন্যদেরও কণ্ঠে শোনা গিয়েছে। ছবির প্রথমার্ধ জুড়ে সেই মেজাজ একই ভাবে বজায় থেকেছে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই পর্দায় সলমনের (Salman Khan) আবির্ভাব। আপনাদের দু’জনকে একসঙ্গে পর্দায় দেখে যে উল্লাস, তা বুঝিয়ে দেয় জনপ্রিয়তার পারদ মাপার থার্মোমিটারের ক্ষমতা নেই দুই খানের সম্মিলিত জনপ্রিয়তাকে মাপার। আজও।
[আরও পড়ুন: মোদির তথ্যচিত্র নিয়ে বিজেপিকে সমর্থনের জের, কংগ্রেসের ক্ষোভের মুখে দলত্যাগ অ্যান্টনি-পুত্রর]
কিন্তু সেসব না হয় হল। ছবিটা কেমন দাঁড়াল? ‘র’-এর প্রাক্তন এজেন্ট জিম (জন আব্রাহাম) ব্যক্তিগত ক্ষতির আঘাতে জর্জরিত। সে বলে, তার কোনও দেশ নেই। সে একটা এমন জঙ্গি গোষ্ঠী চালায়, যারা স্রেফ চুক্তিভিত্তিক হামলা করে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ মেনে। আর এবার তার লক্ষ্য ভারত। যাকে আটকাতে পারে পাঠান। এবং তার বাহিনী ‘জেওসিআর’। এরপর শুরু হয় টক্কর। এরই মধ্যে পর্দায় দীপিকা। শেষ পর্যন্ত জানা যায়, জিমের নির্দেশে ল্যাবে তৈরি হয়েছে এমন জীবাণু (ছবিতে যাকে বলা হচ্ছে রক্তবীজ) যা মানুষকে আক্রান্ত করলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে লুটিয়ে পড়বে। এহেন ভয়াল জীবাণুর আঘাতে কি জনহীন হয়ে যাবে দিল্লি?
শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটা জানাই। কিন্তু এই ছবি তো রুদ্ধশ্বাস ‘হুডানইট’ খুনের কাহিনি নয়। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ স্পাই থ্রিলার। ফলে শেষ পর্যন্ত গল্পকে কীভাবে বোনা হচ্ছে, বিনোদন কতটা থাকছে সেটাই আসল। আর সেখানে অনেকটাই সফল পরিচালক সিদ্ধার্থ আনন্দ। কিন্তু… তবুও বলতেই হবে প্লটহোল অবশ্যই রয়েছে ছবিতে। বহু জায়গায় এত বেশি ‘লাইসেন্স’ নেওয়া হয়েছে মানা কঠিন। যেভাবে আপনি দীপিকার প্রেমে চট করে পড়ে গেলেন, সেটাও কেমন খচখচ করে। অত বড় হামলার নীল নকশা আরও নিখুঁত হওয়ার কথা। কিন্তু সেই ত্রুটি সত্যিই ঢেকে দেয় ছবির কুশীলবদের ঝকঝকে উপস্থিতি, দুর্দান্ত আবহসংগীত আর ভিএফএক্সের কারসাজি। ভিএফএক্স অবশ্য প্রথম দুটির মতো ভাল নয় সব জায়গায়। কিন্তু কিছু দৃশ্যে তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। হেলিকপ্টার, প্লেন, বাইক- একের পর এক অ্যাকশন। আর দারুণ সব টুইস্ট।
এই ছবির টিজারে জন ও দীপিকাকে সেভাবে দেখানোই হয়নি। মনে করা হয়েছিল এই ছবি কেবল আপনার। কিন্তু তা একেবারেই নয়। জন আব্রাহামকে ‘ভিলেন’ হিসেবে যত্ন নিয়ে গড়েছেন পরিচালক। চমৎকার অভিনয় করেছেন তিনি। এবং অবশ্যই দীপিকা। লাস্যময়ী ও বিপজ্জনক হিসেবে তিনি অতুলনীয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ছবি আপনারই। কেরিয়ারের শুরুর দিনগুলিতে উজ্জ্বল চোখের রোগা ছেলেটা তার অভিনয় দিয়েই সব কিছু ঢেকে দিত। আজও ‘কভি হাঁ কভি না’ ছবির সেই সুনীলকে মনে পড়ে। যে মিথ্যে বলত, পরীক্ষায় ফেল করত। তবু সব দিক থেকেই ব্যর্থ হয়েও হৃদয়ের কথা বলতে জানত সে। তিন দশক পেরিয়ে এসে অসামান্য দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী এক প্রৌঢ় হয়েও আপনার আসল ইউএসপি কিন্তু সেই হৃদয়বেত্তাই রয়ে গিয়েছে। আলতো হাসি, চোখের ইশারা। জমজমাট অ্যাকশন আর দুরন্ত ওয়ান লাইনারের এই সমন্বয়ে না মজে উপায় নেই।
গোটা বিশ্বে একসঙ্গে ৮ হাজার স্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছে ‘পাঠান’। ভারতে সাড়ে পাঁচ হাজার। বিদেশে আড়াই হাজার। বক্স অফিসে ঝড় উঠেছে। এবং এই ঝড় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ছবি হিট করানোর সব রকম উপাদানই যে মজুত। কিন্তু ‘পাঠান’ কি স্রেফ একটা ছবি? নাহ। এই মুহূর্তে বলিউডের ছবি ঘিরে চলতে থাকা কুৎসিত ‘বয়কট’ ট্রেন্ডকে নকআউট পাঞ্চ করাটা একান্তই দরকার ছিল। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ শুরুটা করেছিল। প্রায় নিশ্চিত, শেষটা করতে চলেছে ‘পাঠান’ই। আর এর মাধ্যমে আপনি, শাহরুখ খান, আবারও প্রমাণ করে দিলেন কেবল পাঠানই নয়, এই যুগেও বিনোদন দুনিয়ায় কিং খানের ম্যাজিক ‘জিন্দা হ্যায়’।
ইতি
আপনার এক অনুরাগী