কুণাল ঘোষ: আজ থেকে দশ বছর আগে যখন রাজ্যসভায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর (Netaji Subhas Chandra Bose) অন্তর্ধান রহস্যের সমাধানের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কিছু দাবি তুলেছিলাম, তখন সব দল থেকেই তা সমর্থন করা হয়েছিল। সেসময় ইউপিএ জমানা। অন্য সব দলের পাশাপাশি বিজেপির তরফ থেকেও সমর্থন ‘রেকর্ড’ করানো হয়েছিল। এরপর বিজেপি সরকারেও এসেছে। কিন্তু আজ দশ বছর পর নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর মুহূর্তেও রহস্যের সমাধান হয়নি। নেতাজির প্রতি প্রকৃত সম্মানজ্ঞাপনের পথগুলি এড়িয়ে পদক্ষেপ এবং বিতর্কটা রয়েছে কীভাবে বাংলার নেতাজির ট্যাবলো বাদ দেওয়া যায় বা চাপের মুখে আবেগ সামাল দিতে ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির একটি মূর্তি বসানো যায়, এই বৃত্তের মধ্যেই।
দশ বছর আগে সংসদে আমার মূল বক্তব্য ছিল, নেতাজি সংক্রান্ত ক্লাসিফায়েড ফাইলগুলি প্রকাশ করা হোক। গবেষক চন্দ্রচূড় ঘোষকে ( এবং অনুজ ধর) এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানিয়েছিল এগুলি প্রকাশিত হলে অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হবে, যে বিষয়টি আমাদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত। আমাদের যুক্তি ছিল, এত দশক পরও আজকের পরিবর্তিত পৃথিবীতে এই যুক্তিতে দেশনায়কের মৃত্যুরহস্য ধামাচাপা থাকবে, এটা হতে পারে না। যা—ই হোক, চন্দ্রচূড়বাবুরা সমানে চাপ রেখে গিয়েছেন বলে কিছু নড়াচড়া নিশ্চয়ই হয়েছে বটে। কিন্তু, কোনও অদৃশ্য শক্তি এখনও রহস্য সমাধানে প্রবল বাধা দিয়ে চলেছে।
[আরও পড়ুন: পড়ুয়াদের কথা ভেবে নয়া উদ্যোগ রাজ্যের, চালু হচ্ছে ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’]
যে দাবিগুলি এখনও স্পষ্টভাবে থাকছে :
১)নেতাজি সংক্রান্ত সব ক্লাসিফায়েড ফাইল প্রকাশিত হোক। বিশেষত একটি ফাইলের কথা শোনা যাচ্ছে যেটি কেন্দ্রের হাতে রয়েছে। বস্তুত কোথায় ঠিক ক’টি ফাইল রয়েছে, সেই তথ্যটিই স্পষ্ট নয়। ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলির হাতে থাকা ফাইলগুলি আদৌ সামনে এসেছে কি?
২) জাপানের রেনকোজি মন্দিরে যে চিতাভস্ম আছে, তার ডিএনএ পরীক্ষা হোক। কারণ মুখার্জি কমিশন স্পষ্ট রিপোর্ট দিয়ে বলেছেন, ওই চিতাভস্ম নেতাজির নয়। ওটি তাইওয়ানিজ সেনা ওকুরা ইচিরোর।
৩) যেহেতু নেতাজি তদন্তের তিন কমিশন-শাহনওয়াজ, খোসলা এবং মুখার্জি কমিশনের পর্যবেক্ষণে তাৎপর্যপূর্ণ তফাত এবং সর্বশেষ কমিশনের বক্তব্যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে, তা হলে তার পরের তদন্ত হল না কেন? নেতাজি আজও বেঁচে আছেন, এটা প্রাকৃতিক নিয়মেই অবাস্তব। কিন্তু সেই সময় যদি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু না হয়, তা হলে তার পর তাঁর জীবনে কী হয়েছিল, সেটা জানার চেষ্টা হবে না?
৪) উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদ হাই কোর্টের নির্দেশে গুমনামি বাবার সংগ্রহশালা তৈরি হয়ে পড়ে আছে। অখিলেশ যাদব সরকার এটি করেছে। কিন্তু তারপর যোগী সরকার পাঁচ বছরেও সেটি উদ্বোধন করল না। সেখানে রহস্যময় সেই সন্ন্যাসীর ব্যবহৃত এমন অনেক জিনিস রয়েছে, যা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আবার অখিলেশ সংগ্রহশালা করলেও গুমনামিবাবার পরিচয় জানতে আলাদা তদন্তের পক্ষে ছিলেন না। নানা অনুরোধে তিনি বিষ্ণু সহায় তদন্ত কমিটি করলেও এই তদন্তের কর্মপদ্ধতিতেই গবেষকরা বুঝেছিলেন, কাজের কাজ না করার পূর্বনির্ধারিত মানসিকতাতেই চলছে তথাকথিত তদন্ত। এঁরা বলেছেন গুমনামিবাবা নেতাজি নন। কিন্তু গুমনামি মানুষটি কে, তা বলতে পারেননি। এড়িয়ে গিয়েছেন। যা—ই হোক, গুমনামিবাবার সংগ্রহশালা অবিলম্বে জনসমক্ষে খুলে দেওয়া দরকার। এটি রয়েছে অযোধ্যার রামকথা মিউজিয়াম প্রাঙ্গণে।
৫) নেতাজির স্বীকৃতি দরকার দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাতে নেতাজি প্রধানমন্ত্রী, সঙ্গে সমর ও বিদেশদপ্তর। তা ছাড়া ফৌজের প্রধান সেনাপতি তিনিই। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন- মহিলা দপ্তর। লে. কর্নেল এ সি চট্টোপাধ্যায়- অর্থ (জাতীয় ব্যাংকও গঠন করা হয়েছিল)। এস এ নায়ার- প্রচার। রাসবিহারী বসু- প্রধান উপদেষ্টা। এ এন সরকার- আইন উপদেষ্টা। আরও কয়েকজন একাধিক পদে ছিলেন। ২৩ অক্টোবর জাপান এই সরকারকে মান্যতা দেয়। এরপর চিন, মানচুকু, ইতালি, জার্মানি, ফিলিপিন্স, শ্যাম ও বর্মা এই সরকারকে মান্যতা দেয়। নভেম্বরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ আজাদ হিন্দ সরকারকে দেন জেনারেল তোজো, নেতাজি নাম দেন শহিদ ও স্বরাজ। ১৮ মার্চ সীমান্ত পার হয়ে ভারতেও প্রবেশ করে ফৌজ।
[আরও পড়ুন: স্ত্রীর সামনেই মুম্বইয়ের মহিলাকে ‘ধর্ষণ’, ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল, কলকাতা থেকে ধৃত দম্পতি]
আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম চিকিৎসক ও এই ঘটনাগুলির সাক্ষী ডা. সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে’ লেখাটিতে সব তথ্য রেখে গিয়েছেন। প্রশ্ন হল, যদিও ভারত তখনও সরকারিভাবে স্বাধীন হয়নি, কিন্তু নেতাজির এই প্রবল সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার স্বীকৃতিকে মান্যতা দিয়ে আমরা কেন নেতাজিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি দেব না? কেন তাঁর সরকার প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত বিবরণ আজকের প্রজন্মের পাঠ্যসূচিতে থাকবে না? হতে পারে সেটি অস্থায়ী সরকার কিংবা হতে পারে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন, কিন্তু আমরা তার স্বীকৃতি দেব না কেন? চিরাচরিত সংক্ষিপ্ত উল্লেখ নয়, তাঁর কাজ এবং ভাবনার বিস্তারিত উল্লেখ দরকার।
ব্রিটিশ শক্তির কুৎসিত অপপ্রচারে বিরক্ত ছিলেন নেতাজি। কিন্তু তার থেকেও ক্ষুব্ধ ছিলেন দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের উপর। ডা. বসু নেতাজিকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “যারা আমাকে হত্যা করতে পারলে খুশি হত, তাদের পক্ষে এই প্রচারের অর্থ অবোধ্য নয়। কিন্তু সব চাইতে আশ্চর্য ও অপমানজনক বিষয় হচ্ছে যে, ১৯৪৪ সালেও এমন ভারতীয় পাওয়া যাচ্ছে, যারা সামান্য অর্থের জন্য আত্মবিক্রয় করে এইরকম নোংরা কাজ করে। ব্রিটিশ যে আমাকে ‘কুইসলিং’, ‘পুতুল’ বলে গালাগালি দেবে, এ তো স্বাভাবিক, কিন্তু মিথ্যা প্রচারকার্যের জন্য এখনও তারা মিরজাফর ও উমিচাঁদকে পাবে কেন?” ডা. বসুর লেখা যেমন অন্যান্য সূত্র থেকে আসা তথ্যকে আরও সমৃদ্ধ করছে; তেমনই চন্দ্রচূড় ঘোষ এবং অনুজ ধররা রহস্যের সমাধানে তাঁদের লড়াই অব্যাহত রেখেছেন। দশ বছর আগে যখন বিষয়টি রাজ্যসভায় তুলি, সহযোগিতা করেছিলেন চন্দ্রচূড়। পরবর্তীকালে সুখেন্দুশেখর রায়ও বিষয়টি একাধিকবার উত্থাপন করেছেন। সর্বশেষ যা তথ্য রয়েছে, তাতে চন্দ্রচূড় জানাচ্ছেন, কেন্দ্র ৩০৪টি ফাইল ডিক্লাসিফাই করেছে, কিন্তু ৩০৩টি জাতীয় সংগ্রহশালাগুলিতে দিয়েছে। বাকি একটির কোনও খবর নেই। সেটি নাকি অতিস্পর্শকাতর। এ নিয়ে কোনও সরকারি ঘোষণাও নেই।
এহেন পরিস্থিতিতে নেতাজির জন্মবার্ষিকীতে আমাদের দাবি, সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টি যেন ট্যাবলো বা মূর্তিতে সীমাবদ্ধ না থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা নিন, শুধু মূর্তি আর ভাষণে আবেগ নিয়ে রাজনীতি করবেন না।