shono
Advertisement

হায় মরে বাংলা ভাষা

কবে আমরা নিজেদের ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে শিখব?
Posted: 02:01 PM Mar 24, 2023Updated: 02:02 PM Mar 24, 2023

ইংরেজি শেখার কিছু বাস্তব সুবিধা আছে। এ ভাষা পারে মানুষকে আ-পৃথিবী নাগরিকত্ব দিতে। সর্বভারতীয় স্তরে যে শক্তি আছে হিন্দির। বাংলা তবে যায় কোথায়? উদ্ধতভাবে তাহলে এই কথা কি চলতেই থাকবে যে, বাংলা মরণাপন্ন, ফলে এ-ভাষা শেখার দরকার নেই! লিখলেন পবিত্র সরকার

Advertisement

সম্প্রতি আড়িয়াদহের এক ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের প্রধান শিক্ষকের এক বাংলার শিক্ষিকাকে বরখাস্ত করার একটি চিঠি ঘিরে খুব তোলপাড় হয়ে গেল। চিঠিটির ভাষা সংগত হয়নি, কিন্তু তা এ-নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। সুখের বিষয়, সেই শিক্ষিকাটিকে আবার ফিরিয়ে নিয়েছে ওই স্কুল। স্থানীয় বিধায়ক কীভাবে তাঁদের মত পরিবর্তনে সাহায্য করলেন, তা-ও আমাদের আলোচ্য নয়, যেমন আলোচ্য নয় বাংলা পড়ার ছাত্র নেই যে-স্কুলে, বাংলার শিক্ষিকাকে দিয়ে এখন সে-স্কুল কী করাবে।

ঘটনাটা থেকে একটা দীর্ঘদিনের সামাজিক প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা বাংলা ভাষার পক্ষে বা ইংরেজি ছাড়া যে কোনও মাতৃভাষার পক্ষে, খুব সুসংবাদ বহন করে না। তা হল, এক শ্রেণির অভিভাবকের যে কোনও মূল্যে সন্তানদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর উদগ্র ব্যগ্রতা। তার জন্য তাঁদের অপরাধী করার আগে এর কারণগুলিও বুঝি আমরা। একনম্বর কারণ, তঁারা ভাবেন যে (সে-ভাবনা ভুলও নয়) ইংরেজি ভাল বলতে-লিখতে শিখলে তাঁদের সন্তানদের নানারকম সুযোগ খুলে যাবে। একটা সুযোগ, উচ্চশিক্ষায়– সেটা এদেশে হোক, বা বিদেশে হোক। অর্থাৎ, ইংরেজি শিক্ষাক্ষেত্রে বা কর্মক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে, হয়তো সারা পৃথিবীতে সুযোগ এনে দেয়। আমাদের সমাজে আর-একটা সুযোগ, শিক্ষার পর ‘ভদ্রলোক’-এর যোগ্য চাকরিবাকরি পাওয়াতে– যাকে তঁারা ‘সাফল্য’ বলে মনে করেন। ইংরেজি সাফল্যের ভাষা; তৃতীয় সুযোগ বা অর্জন, ‘ভদ্রলোক’-এর মর্যাদা, যা তঁাদের সন্তানকে ইংরেজি না-জানা ‘অশিক্ষিত’ (আসলে ‘নিরক্ষর’) চাষি, মজুর, বাজারের বিক্রেতা আর শ্রমজীবীর থেকে আলাদা করে দেবে। জাত-পাত ক্লিষ্ট এই সমাজে ‘ভদ্রলোক’ হওয়া একটা প্রাণপণ লক্ষ‌্য, কারণ ‘ভদ্রলোকরা’ সম্মানিত হন, আর ‘না-ভদ্রলোকেরা’ (আগে অন্য একটা শব্দ ব্যবহার করা যেত) লোকব্যবহারে তত সম্মান পান না।

[আরও পড়ুন: আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের দেওয়া সার্টিফিকেটকে মান্যতা আদালতের, সর্বত্র গ্রহণ করার নির্দেশ]

ভদ্রলোকেদের অনেকেই এখনও তঁাদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ করে কথা বলেন, আরও নানাভাবে অবজ্ঞা দেখান। তঁারা সেটা বোঝেন বলে তঁারাও তঁাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর জন্য প্রাণ পণ করেন, সে-স্কুল যেমনই হোক। আর ওসব স্কুলে তো ছেলেমেয়েরা শুধু ভাষা শিখবে না, তারা একটা ‘সংস্কৃতি’ বা জীবনাদর্শের মধ্যে প্রবেশ করবে। তা হল একধরনের সাহেবিয়ানা, সুট-বুট কোট-টাই পরা বাদামি ইংরেজ বা আমেরিকান। এটা পুরোটা নেতিবাচক নয়। এই সংস্কৃতি তাকে প্রাদেশিকতা থেকে বাইরে পৌঁছে দেয়, হয়তো পৃথিবীর নাগরিকত্ব দেয়। আবার সেই সঙ্গে গায়ের রং যাই হোক, ওই চেহারা, ভাষা আর আচরণের সামাজিক মর্যাদা যেমন আমাদের সমাজে, তেমনই অন্যত্রও, অনেক বেশি।

প্রভাবের দ্বিতীয় স্তরে আছে হিন্দি ভাষা। তা ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা, ইংরেজির পাশাপাশি, আর এখনকার কেন্দ্রীয় সরকারও নানাভাবে তার প্রভাব ও শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমাদের সংস্কৃতিতে আগে থেকেই তার একটা বেসরকারি প্রভাব ছিল। হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল, গান ইত্যাদি আমাদের কাছে দিব্য অভ্যর্থনা পায়। এখন তো তা শিখলে ‘সুযোগ’-ও বেশি পাওয়া যায়, অন্তত সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে– এটাই অনেকের ধারণা। কাজেই, ওইসব স্কুলে বাংলাও তৃতীয় পছন্দ বা না-পছন্দের ভাষার পর্যায়ে নেমে এসেছে। এটা স্কুলের ‘ষড়যন্ত্র’ বা ‘অপরাধ’ বলা বোধহয় অনুচিত হবে।

[আরও পড়ুন: চাকরির নামে ৫ কোটি টাকা প্রতারণা! পূর্ব মেদিনীপুরের শিক্ষকের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে প্রার্থীরা]

ভারত সরকার সকলের একধরনের শিক্ষার নীতি কোনও দিন গ্রহণ করেনি, না স্বাধীনতার আগের ঔপনিবেশিক সরকার, না স্বাধীন দেশের সরকার। আগে থেকেই ‘এলিট’ বা এলিটত্ব-অভিলাষীদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ছিল, পাহাড়ি শহরের ‘পাবলিক স্কুল’গুলিতে, কিংবা শহরের সিনিয়র কেমব্রিজ পাঠ‌্যক্রমের স্কুলগুলিতে। পরে স্বাধীন দেশের সরকার তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলিকে যুক্ত করে, জোর করে সকলের জন্য সমান শিক্ষার প্রবর্তন করতে পারেনি। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির বাধা ছিল, শাসকরা নিজেদের সন্তানদের জন্যও বোধহয় এলিটদের শিক্ষা-ই চেয়েছিলেন। তা-ও স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত ‘ইউপি বোর্ড’ থেকে পরে দশ ক্লাসের যে বোর্ড; ‘সিবিএসই’ হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আর বারো ক্লাসের যে ‘আইএসসি বোর্ড’ তার পরেই তৈরি হল, তার ইংরেজি মাধ্যম নীতির উপর কোনও নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ স্বাধীন ভারতের সরকার আনতে পারেনি।

সিবিএসই-র ঘোষণা দেখলাম, সে প্রতিষ্ঠান ‘committed to equity and excellence’, কিন্তু ভারতে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা equity-কে কঁাচকলা দেখায়। ওদিকে কেন্দ্রীয় সরকার তার দু’-মুখো উচ্চারণ করেই গিয়েছে নানা কমিটি-কমিশনে ‘মাতৃভাষা’য় প্রথম কয়েকটি ক্লাস শেখানো সম্বন্ধে ওষ্ঠসেবা দিয়ে। ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতিতেও তা-ই করা হয়েছে। অর্থাৎ, দুটো সমান্তরাল ব্যবস্থা– ইংরেজি মাধ্যম এলিটদের বা এলিটত্ব-উন্মুখদের সন্তানদের জন্য; আর নিম্নবিত্ত ও গরিবদের সন্তানদের জন্য মাতৃভাষা মাধ্যম। ২০২০-র উচ্ছ্বাসপূর্ণ শিক্ষানীতিতেও তারা বলতে পারল না যে, নিজের ভাষায় শিক্ষার দিকে আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাব, ইংরেজিকেও পাশাপাশি শেখাব। তারা ক্লাস এইটের সীমা নির্দেশ করল মাতৃভাষার জন্য, একটা সৌখিন আশা প্রকাশ করল ‘and beyond’ বলে। কিন্তু কবে, কীভাবে হবে তা বলল না। পরের শিক্ষানীতিতেও বলবে না। তার কারণ, এই বিষম শিক্ষানীতি তাদের অব্যাহত রাখতেই হবে, নিজেদের শ্রেণি আর গোষ্ঠীর স্বার্থে।


তবে ‘মাতৃভাষা’-র কী গতি হবে? এত দিন সরকারি স্কুলে তার একটা ঠাঁই ছিল, এখন শুনি সরকারও নাকি তার পোষিত কিছু স্কুল ইংরেজি মাধ্যম করার জন‌্য উঠেপড়ে লেগেছে। সরকারকে এই সর্বনেশে সত্যটা বুঝতে হবে যে, ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়বে, তাদের প্রত্যেকের কাছেই মাতৃভাষা অবান্তর না হলেও তুলনায় তুচ্ছ হয়ে যাবে। স্কুলও যখন উদ্ধতভাবে বলে যে, স্কুলে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষা (নিজের ভাষা) বলা চলবে না, বাড়িতেও ইংরেজি-জানা (!) মা-বাবা প্রাণপণে সন্তানকে বাধা দেন ইংরেজির বদলে বাংলা বলতে। বাঙালির সন্তান তাই বাংলাটাকে ভীষণ কঠিনভাবে, তাদের বাপ-মা’দেরও ধারণা, তিনটে ‘শ’ আর দু’-খানা ‘ণ’ আর যুক্তব্যঞ্জন নিয়ে বাংলাটা একটা বিতিকিচ্ছিরি ‘বর্বর’ ভাষা! বাঙালি হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেদের অভিশপ্ত বোধ করে। ইংরেজির কোনও দোষ বা সমস্যা তারা দেখে না। আবার এ-ও তারা দেখে যে, প্রশাসনিক আর অন্যান্য কাজে বাংলা ভাষায় ব্যাপক ব্যবহারের জন‌্য সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই, কলকাতা পুরসভার লোকেরা পথে পথে ‘I love Benepukur’ বলে আলোর বিজ্ঞাপন দেয়, ‘লাভ’-এর জায়গায় লাল হৃদয়ের ছবি দিয়ে। কবে আমরা নিজেদের ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে শিখব? ফলে, এই ভয় ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে যে, বাঙালি ছেলেরা ক্রমশ বাংলার প্রতি বিমুখ হবে, অভিভাবকদের প্ররোচনায় বাংলা কম শিখবে। তখন এত পত্রপত্রিকা, বিপুল সাহিত্য– সেসবের পাঠক কোথায় পাব?

সরকার আরও যা করতে পারে, তা হল, বাংলা স্কুলে ভাল করে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা। বাংলা বা নিজের ভাষায় ছেলেমেয়েরা যতদূর ইচ্ছে পড়ুক, কিন্তু ওসব স্কুলে তাদের ইংরেজি ভাষাটা যেন আরও ভাল করে শেখানো হয়। সাহিত্যের পাঠ নয়, ভাষাটা বলা আর লেখার পাঠ। তার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যঁারা ৪০ বছর আগে ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরেজির জন্য আন্দোলন করেছিল, ২০০১-এ তাদের ইচ্ছা ও স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছে। তবে এখনও ইংরেজি মাধ্যমের জন্য হাহাকার কেন?

বাংলা ভাষা ক্লাসিক‌্যাল মর্যাদা পেল বা না পেল, তাতে আপাতত এ-ভাষার কিচ্ছু এসে-যায় না। অন্য ভাষার লোক বাংলার স্কুলে বাংলা পড়ল কি না, তা নিয়েও আমি চিন্তিত নই। আমি চিন্তিত বাঙালির ছেলেমেয়ে স্কুলে বাংলা পড়ল কি না। বাংলা স্কুলে-কলেজে মাধ্যম হিসাবে থাকছে কি না, সরকার নানা কাজে ব্যবহার করছে কি না, বাড়িতে বাবা-মায়েরা সন্তানদের বাংলা বলতে ও পড়তে-লিখতে উৎসাহ দিচ্ছেন কি না, এমনকী, রাস্তায় সাইনবোর্ডে ছেলেমেয়েরা বাংলা লেখা দেখছে কি না– সেটাই গভীর চিন্তার বিষয়। সরকার, নাগরিক, আন্দোলনকারীরা একসঙ্গে মিলে এই কথাটা ভাবুক।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement