বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: বাঙালি দর্শককে এখন পেয়েছে গোয়েন্দা এবং ভূতে। এ ছাড়া তাদের হলমুখো করার আর জো রইল না, এমনটাই মনে করছেন অনেকেই। নবীন পরিচালক কাকলি ঘোষ এবং অভিনব মুখোপাধ্যায়ও কী তাই সেই পথেই হাঁটলেন! তাঁদের ডেবিউ ছবি‘ভূতপূর্ব’ অতীত এবং অতিপ্রাকৃতদের নিয়েই তৈরি। ভূত মানে যেমন জীবনের অতীত, তেমনই ফেলে আসা সময়। সাহিত্য নির্ভর হয়ে সেই পিছন দিকেই হাঁটলেন তাঁরা এবং তাঁদের ছায়াছবির ছায়াময় চরিত্ররাও।
এক বৃষ্টির রাতে উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িতে আড্ডায় তিন জন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (সপ্তর্ষি মৌলিক) বাড়িতে এসেছে নীলকণ্ঠ (সত্যম) ও শশধর (সুহোত্র মুখোপাধ্যায়)। যে যার নিজের গল্প বলবে, এই হচ্ছে প্রেক্ষাপট। পরিচালকদ্বয় এই তিন জনকেই কেন বেছে নিলেন সেটা দর্শক হিসাবে আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়। তিনটে গল্পের সময়কাল একে অপরের সঙ্গে কয়েনসাইড করতে করতে এগিয়েছে। ১৮০০-র মাঝামাঝি থেকে ১৯৫০-এর মধ্যবর্তী সময়। যদিও গল্পকার মনোজ সেন সমসাময়িক এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগোত্রীয় নন। এবং ‘মণিহারা’ ও ‘তারানাথ তান্ত্রিক’-এর পাশাপাশি তাঁর‘শিকার’গল্পের চলন আলাদা। তবে ছবির ক্ষেত্রে পরিচালকদ্বয় তিনটে গল্পকে একসূত্রে বেঁধেছেন অন্য কৌশলে। তিন গল্পেই কণ্ঠ পুরুষের এবং তাঁরা বলছেন তাঁদের জীবনের নারী অভিজ্ঞতা নিয়ে। তিন গল্পেই পুরুষ চরিত্রে আছে দুর্বলতা বা নেতিবাচক দিক অর্থাৎ তাঁরা ভালো-মন্দ মিলমিশে রক্তমাংসের মানুষ। আর নারী চরিত্ররা হলেন, অতিপ্রাকৃত ও শক্তিশালী এবং সেই শক্তির কাছে পুরুষ কখনও ভিকটিম (নীলকণ্ঠ-ফণীভূষণ), কখনও অনুরাগী (বিভূতিভূষণ-তারানাথ) কখনও শত্রু (শশধর-পূর্ণেন্দু )। কিন্তু তাঁদের পরিণতি একটাই —পতন! এবং এই ছবি তাঁদের যোগাযোগস্থল যেখানে তাঁরা নিজেদের এবং এই তিন নারীকে নিয়ে আলোচনা করে বা আতস কাঁচের তলায় রাখে নিজেদের জীবন! এই তিন নারীকে ঘিরে ফণীভূষণের ক্ষোভ, হতাশা, তারানাথের সমর্পণ এবং পূর্ণেন্দুর স্বরে ঝরে পরে এক ধরনের তির্যকতা, ঈর্ষা আর হতাশা। ছবির উদ্দেশ্য কী সেটাই? ভূতের গল্প বলা নাকি ভয় দেখানো? আজকাল ভূতে কী তেমন ভয় লাগে?
তবে তিনটে আলাদা আলাদা গল্পের মধ্যে দারুণ লাগল সুহোত্র মুখোপাধ্যায়কে। ‘পূর্ণেন্দু’র মতো ধোঁয়াটে চরিত্রে তাঁকে এর আগে দেখিনি। এক বিদূষী সুন্দরী নারীকে (সন্দীপ্তা সেন) বশ করতে প্রেমের ফাঁদ পাতাই তার কাজ। এমন এক বুদ্ধিদীপ্ত রূপবান জালিয়াতের চরিত্রে তিনি দারুণ। ক্রমাগত ইমোশন শিফটিংয়ে তার অভিনয় হোঁচট খায়নি। পাকা শিকারির মতো তার শিকারকে একেবারে পেড়ে ফেলতে সে হাতিয়ার করে নিজের শরীরকে। নানান ছুতোয় শার্ট খুলে ফেলে নিজেকে অনাবৃত করে, হাতছানি দেওয়ার দৃশ্যে সুহোত্র বেশ সাবলীল। একেবারে সরাসরি মেল অবজেক্টিফিকেশন বাংলা ছবিতে খুব একটা দেখা যায় না। আর প্রলোভনকারীর চরিত্র সাধারণত নারীর জন্যই বরাদ্দ। আমরাও তাই দেখে অভ্যস্ত। তাই এই ব্যতিক্রম চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে সন্দীপ্তা সেনের স্নিগ্ধ উপস্থিতি দর্শকদের ভালো লাগবে। এই গল্পটা নিয়েই একটা গোটা ছবি হতে পারত ।
‘মণিহারা’গল্পে অমৃতা-সত্যম খুবই মানানসই। প্রথমত এই গল্পে আলাদা করে কিছু প্রমাণ করা খুব সহজ ছিল না। সকলের স্মৃতিতেই সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’জ্বলজ্বল করছে। তবু অমৃতা-সত্যম গল্পের মূল নির্যাস ধরে রাখতে পেরেছেন তাঁদের অভিনয় দিয়ে। ক্যামেরা সাহায্য করেছে সেই আধিভৌতিক পরিবেশ তৈরি করতে, তবে ক্লাইম্যাক্সে ভিএফএক্স সাবোটাজ করেছে বলা যায়।‘তারানাথ’-এর গল্পেও সেই এক সমস্যা। আসলে গা ছমছম পরিবেশ, অজানার ভয়, তৈরি করতে যে মুনশিয়ানার প্রয়োজন সেটার খামতি আছে। ‘তারানাথ’-এর গল্পে সপ্তর্ষি মৌলিকের চেহারাটা একটু বেশিই পালিশ করা সুপুরুষ এবং নায়কোচিত। সেখানে মেঠো ভাবের অভাব আছে, তাই বোধহয় বিশ্বাসযোগ্য কম লাগে। রূপাঞ্জনা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ‘মাতু পাগলি’র চরিত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে।আর সেই সঙ্গে টেকনিক্যাল দিক অর্থাৎ ভিএফএক্স-এর অপারগতা তো আছেই। সব মিলিয়ে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় ছবি দেখতে গিয়ে। 'ভূতপূর্ব' (Bhutopurbo),অভূতপূর্ব হয়ে ওঠার পথে একটু পিছিয়ে রইল বলে মনে হয়। সাহিত্য নির্ভর 'ভূতপূর্ব' হিট ও মিস দুইই করল তবে প্রথম প্রয়াস হিসাবে প্রশংসা প্রাপ্য পরিচালকদ্বয় এবং অন্য কলাকুশলীদের।
