shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: গণতন্ত্র ও করোনার সহবাস

মহামারীর মাঝেই চলছে ভোটগ্রহণ।
Posted: 12:26 PM Apr 17, 2021Updated: 12:26 PM Apr 17, 2021

জয়ন্ত ঘোষাল: কোভিডের ‘দ্বিতীয় ঝড়’ ভয়ংকরভাবে আছড়ে পড়েছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, করোনায় মানুষ কীভাবে মারা যাচ্ছে। প্রায় দু’মাস পর কলকাতা থেকে দিল্লি এলাম। বিমানবন্দরে নামতেই দেখি করোনা-পরীক্ষার বিস্তর আয়োজন। আমাদের হাজারটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বেরতে হল। মুম্বই থেকে আসা যাত্রীদের করোনা-সংক্রান্ত নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে, তবেই তাঁরা দিল্লিতে প্রবেশের ছাড়পত্র পাবেন। আমার চোখের সামনে বিভিন্ন বয়সের মানুষ সেই রিপোর্ট দেখাতে না-পারায় তাঁদের মুম্বই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। দিল্লি পৌঁছে শুনলাম, আমাদের বাড়ির কাছের যে-শ্মশান, নিজামুদ্দিনের কাছে– সেখানে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছে যে, রীতিমতো স্থানাভাব তৈরি হয়েছে। ফলে শ্মশানের বাইরে রাজপথে মৃতদেহবাহী গাড়িগুলিকে দাঁড় করিয়ে রাখতে হচ্ছে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: রামকে কেন ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ বলা হয়]

কলকাতায় যে দু’মাস ছিলাম, খুব অবাক হয়ে দেখছিলাম যে, বেশিরভাগ জায়গাতেই মানুষ করোনার নিয়ম-কানুন কিছু মেনে চলে না। সর্বত্রই একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। শান্তিনিকেতনে নববর্ষ পালন উৎসবে মানুষ মাস্ক না পরে হাজির হয়েছে। সে-দৃশ্য টিভিতেই দেখা গেল। আমি থাকতাম দমদমের আড়াই নম্বর গেটের কাছে, মতিলাল কলোনির কাছে। সেখানে যখন সকালে চা খেতে যেতাম পাড়ার দোকানে, তখন দেখতাম প্রায় কারও মুখেই মাস্ক নেই। কলেজ স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট– সর্বত্রই জনজীবনের এক ছবি। এমনকী, নন্দীগ্রামে কিংবা উত্তরবঙ্গে নির্বাচন দেখতে গিয়েও দেখেছি মিছিলে, রোড শো-য় কিংবা জনসভায় খুব কম মানুষই মাস্ক পরে আছে বা নিয়মকানুন মানছে।

এদিকে করোনা কিন্তু বেড়েই চলেছে। মার্চ মাসের শুরু থেকেই ১০০০ থেকে ২০০০ নতুন কেস প্রতিদিনই দেখা দিয়েছে। প্রত্যেক দিন নতুন কেস বাড়তে বাড়তে মার্চ মাসের শেষে ৭০০০ থেকে ৮০০০ হয়ে যায়। ১ এপ্রিলের মধ্যে গোটা দেশে সর্বমোট অ্যাক্টিভ কেসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬,১০,৯২৭। ৬ এপ্রিল ভারত দেখল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১,১৫,৩১২ জন সংক্রমিত। এই অতিমারী এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এসে পেঁৗছেছে, যা আমরা কখনও দেখিনি। এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন এবং বড় নির্মম।

আমাদের দুর্ভাগ্য, এসবের মধ্যেই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে পাঁচটা রাজ্যে ভোট হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে আট দফায় ভোট হয়েই চলেছে। সেই কবে ভোট শুরু হয়েছিল, যেন মনে হচ্ছে, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা! প্রতিনিয়ত কলহ, মারামারি, গুলিচালনা, মৃত্যু, অভিযোগ-পালটা অভিযোগ, সন্ত্রাসের হল্লা। আর এসবের মধ্যে হয়ে চলেছে গণতন্ত্রের সবথেকে বড় পরীক্ষা– নির্বাচন। মানুষ উত্তেজিত, যেন জীবন-মরণপণ। কিন্তু পরোয়া নেই যে, করোনায় আক্রান্ত হলে কী হবে? করোনায় মৃত্যুর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল– পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন হবে না প্রত্যাবর্তন হবে, সে প্রশ্নের উত্তর জানা।

উত্তরবঙ্গে তো কংগ্রেসের প্রার্থী রেজাউল হক করোনায় আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা গেলেন। তাঁকে যখন অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তখন তিনি কার্যত মৃত। আরও কয়েকজন প্রার্থীর করোনা-আক্রান্ত হওয়ার খবর ইতিমধ্যেই আমাদের কাছে এসেছে। আবার সংবাদপত্রে পড়লাম যে, করোনা-আক্রান্ত এক ব্যক্তি ভোট দিতে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে করোনার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভোট দেওয়া। এই নির্বাচন তো প্রায় বজ্রনির্ঘোষ! কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, করোনা-রোগীকে বুথে ঢোকানোর আগে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অবকাশ থাকে না! আসলে, মূল সমস্যাটা বোধহয় ম্যালথসের সেই তত্ত্বেই নিহিত। যেদেশে এত জনসংখ্যা, সেদেশে গণতন্ত্রের পরীক্ষা, তার প্রকৃতি, তার চরিত্র এইরকমই হয়।

নীতি আয়োগের সদস্য ড. ভি. কে. পল বলেছেন যে, আমরা খারাপ থেকে আরও ভয়ংকর খারাপের দিকে যাচ্ছি। কোভিড এখন খুব সক্রিয়। খুব শিগগিরই তা ভীষণভাবে স্ট্রাইক ব্যাক করতে যাচ্ছে। যখন আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, বোধহয় কোভিডটা নিয়ন্ত্রণে এসে গেল– ঠিক সেই সময়ই এটা স্ট্রাইক ব্যাক করতে শুরু করেছে। এখন যেটাকে ‘দ্বিতীয় কোভিড ওয়েভ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, সেটার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল, এবার শুধু একটা নয়, চারটে ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে সে আসছে। যেটাকে ‘চিনা ভাইরাস’ বলে আমরা অভিহিত করেছিলাম, সেই আদি চিনা ভাইরাস-ই (D614G) চাররকম ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আসছে। সুতরাং, একজন ব্যক্তিকে যদি এই ভাইরাস আক্রমণ করে, তাহলে সেই ভাইরাসের মিউটেট করার একটা সম্ভাবনা থাকে। ভাইরাস-আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে মিউটেশন হবে– তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। তার ফলে আরও অনেক বেশি রোগ, আরও অনেকরকমের সমস্যা দেখা দেবে। ভারতে ৭০০০ ভ্যারিয়েন্ট এখনও পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এবার এই ঝড়ে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে– সেটা আমরা এখনও কেউ বলতে পারছি না। ‘ইম্পিরিয়াল কলেজ স্টাডি’ থেকে জানা যাচ্ছে, এবারের করোনা-আক্রমণে ইনফেকশনের সম্ভাবনা শতকরা ৭০ ভাগ বেশি। এই আক্রমণের প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনের সুযোগ থাকবে অনেক কম।

এরপরেও যদি ভারতের রাজনৈতিক নেতারা করোনা নিয়ে তাঁদের সচেতনতার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেন তাঁদের ক্ষমতার রাজনীতিকে, তাহলে কিছু বলার নেই। গিনিপিগ কিন্তু হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তারা নেশাগ্রস্তর মতো নিজেদের গণতন্ত্রের পরীক্ষার মস্ত বড় নির্ধারক শক্তি ভেবে আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছে। আর, রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা দখলের লড়াই অব্যাহত রাখছে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে রাজত্ব করেছিল। কেরলে তাদের সরকার টিকে ছিল কেবল দু’-বছর কয়েক মাস। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে তারা ভেবেছিল, তাদের হয়তো কোনও দিনই যেতে হবে না। তারপরে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে বিজেপি। কিন্তু সাধারণ মানুষ কী অবস্থায় আছে? জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে পড়ে– “ধরা যাক দু’-একটা ইঁদুর এবার”।

আমাদের কি কোনও ক্ষমতা আছে? আমরা কি সত্যি এই ব্যবস্থাকে কোনওভাবে বদলে দিতে পারি? আমি বলছি না যে, কোভিডের জন্য আমরা রাজনৈতিক সচেতনতা বিসর্জন দিয়ে শুধুই স্বাস্থ্য-সচেতন হয়ে, পরিবেশ-সচেতন হয়ে ভোটের পদ্ধতিটাকেই বিনষ্ট করে দেব। কিন্তু এই মুহূর্তে, যখন দেশে করোনা-সংক্রমণ বাড়ছে, তার মধ্যেই ভোটের দামামা বাজার কি খুব প্রয়োজন? কোভিড-সংক্রমণ ঠেকাতে শেষ মুহূর্তে নববর্ষের মেলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল গড়ফা থানার পুলিশ। তখন মনে মনে প্রশ্ন জাগে, কুম্ভমেলায় যেভাবে মানুষ মাস্ক ছাড়া ঈশ্বরের প্রতি অন্ধবিশ্বাস নিয়ে হাজারে হাজারে একত্র হয়ে গঙ্গায় ডুব দিচ্ছে– সেটারও কি খুব প্রয়োজন ছিল? একবার যদি কুম্ভমেলাকে আমরা স্থগিত রাখতাম, তাহলে কি মহাপাপ হয়ে যেত? তাই আমার মনে হচ্ছে, বিসমিল্লায় গলদ হয়ে যাচ্ছে। যেন সবাই পশ্চিমবঙ্গে ভোটপর্বটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আর ভোট শেষ হয়ে গেলেই হয়তো শুরু হয়ে যাবে লকডাউন, শুরু হয়ে যাবে সবরকমের বজ্র-আঁটুনি। করোনা দেশের অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে এনেছে। আমরা জানি না, এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে কবে আলোর ক্ষীণ একটা রেখা দেখতে পাব! আর এই তীব্র হতাশা, তীব্র নৈরাজ্যের মধ্যে করোনা এবং নির্বাচন দুটো একই সঙ্গে ঘটে চলেছে। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র এবং করোনার এই সহবাসের পরিণতি কোথায়– তা জানা নেই।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘খাকি’ ও ‘খাদি’-র সংঘাত]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement