সবাই যেমন আমেঠিতে রাহুলকে চেয়েছিল, তেমনই চেয়েছিল রায়বরেলিতে সোনিয়ার ছেড়ে যাওয়া আসনে প্রিয়াঙ্কা-ই বসুন। ধরে নেওয়া যেতেই পারে, ওয়েনাড ও রায়বরেলি দু’-জায়গা থেকেই রাহুল জয়ী হলেন বিপুল ভোটে। তারপর কী করবেন তিনি? একটা আসন তো ছাড়তে হবে! রাহুল তো বটেই, কংগ্রেসকেও পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে অনেক ভেবেচিন্তে। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিন দফার ভোট হয়ে গেল, অথচ আমেঠি ও রায়বরেলি নিয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, এখনও সেই বিতর্কের অবসান ঘটল না। রাজনৈতিক মহলে তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খাচ্ছে, বিজেপির একটু হলেও সুবিধা কংগ্রেস করে দিল কি? না কি আমেঠিতে রাহুল গান্ধীর না দাঁড়ানো কংগ্রেসের মাস্টারস্ট্রোক?
কংগ্রেসের ব্যাখ্যা, এটাই ছিল সেরা উপায়। যদিও উত্তরপ্রদেশের দলীয় ক্যাডারদের বদ্ধমূল ধারণা, রাহুল না দাঁড়ানোয় আমেঠিতে স্মৃতি ইরানি অপদস্থ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। ওই মহল এটাও মনে করে, আমেঠির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না-করে নরেন্দ্র মোদির হাতে রাহুল বাড়তি একটা অস্ত্র তুলে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে রাহুলকে কটাক্ষ করে বলছেন, ‘শাহজাদা সবাইকে ভয় না পেতে বলেন। বলেন, ডরো মাত। আমিও বলছি, ডরো মাত, ভাগো মাত।’
[আরও পড়ুন: দুবছর ধরেই ভারতে বন্ধ কোভিশিল্ড, বিতর্কের মধ্যে দাবি সিরামের]
আমেঠিতে বিজেপির প্রার্থী স্মৃতি ইরানিও আক্রমণাত্মক। তিনি বলছেন, রাহুল তাঁকে এত ভয় পান জানা ছিল না। জানতেন না, রাহুল এত ভিতু। উনি আর কোনও দিনই আমেঠিতে আসার সাহস পাবেন না। কংগ্রেসকে তিনি চিরকালের জন্য আমেঠি-ছাড়া করে ছেড়েছেন। দ্বিতীয় কেন্দ্র হিসাবে রায়বরেলি বাছা, প্রিয়াঙ্কার ভোটে না-দঁাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং আমেঠিতে দলের ৪০ বছরের বিশ্বস্ত ‘ম্যানেজার’ কিশোরীলাল শর্মাকে (বিজেপি নেতাদের ভাষায় যিনি গান্ধীদের চাপরাশি) চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করানোর মধ্য দিয়ে অবশ্য এবারের ভোট-জল্পনার অবসান ঘটছে না। আরও এক কঠিন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় কংগ্রেসকে থাকতে হচ্ছে। কীভাবে সেই পরীক্ষায় রাহুল উতরোবেন, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। সে-আলোচনায় পরে আসছি।
গতবার, ২০১৯ সালে, আমেঠি যে কঠিন ঠঁাই, রাহুল তা আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই দ্বিতীয় কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন কেরলের ওয়েনাড। তঁার আশঙ্কা ভুল ছিল না– বোঝা যায় ফল বেরনোর পর। আমেঠিতে হারেন ৫৫ হাজার ভোটে। মান বঁাচিয়েছিল ওয়েনাড, যার সম্পর্কে মোদি বলেছিলেন, ‘যেখানে গেলে বোঝা যায় না কোথায় আছি। ভারত না পাকিস্তান।’ সেই থেকে কংগ্রেসের গড় আমেঠিকে স্মৃতি ইরানি গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন বিজেপির খাসতালুক হিসাবে। প্রচার করেছেন, গান্ধী পরিবার ওই কেন্দ্রের জন্য কিছুই করেনি। যা কিছু সেখানে হচ্ছে, মোদির বদান্যতায়। ইদানীং রাজনীতির ধর্ম-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে অতীতকে অস্বীকার করার। সেই গড্ডলিকা প্রবাহে স্মৃতিও গা ভাসিয়েছেন।
কিন্তু পাঁচ বছর আগের সেই হাওয়া এবার নেই। পুলওয়ামা-বালাকোটের মতো মোক্ষম কোনও ইস্যুও নেই। প্রথম দুই দফার মতো তৃতীয় দফার ভোটও হল চিরায়ত চেনা ছন্দে। বিজেপি তাতে চিন্তিত বলেই প্রধানমন্ত্রী ঝুলি থেকে কুমিরছানা বের করার মতো ‘মুসলিম জুজু’ মেলে ধরেছেন। স্মৃতির বিরুদ্ধেও পুঞ্জীভূত হয়েছে অনেক কিছু না-পাওয়া ও প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার ক্ষোভ। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস কর্মী ও সমর্থকরা চাইছিলেন রাহুল নতুনভাবে নতুন রূপে ফিরে আসুন। স্মৃতিকে ফেলে দিন কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। প্রিয়াঙ্কা প্রার্থী হন রায়বরেলিতে। এতে উত্তরপ্রদেশে বান না এলেও, কংগ্রেসের মরা গাঙে জলরেখা অন্তত দৃশ্যমান হবে। দিল্লিতে এ নিয়ে কত দরবারও যে তাঁরা করেছেন, ইয়ত্তা নেই। কিন্তু রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা মুখ ফেরালেন।
এ নিয়ে ভাই-বোন দু’জনেরই কিছু ভিন্ন ধারণা কাজ করেছে। রাহুল মনে করেছেন, তিনি আমেঠিতে দাঁড়ালে স্মৃতি ইরানিকে অহেতুক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। লড়াইটা হয়ে যেত ‘প্রেস্টিজ ফাইট’।
[আরও পড়ুন: অভিযোগকারীরা বিজেপির মুখোশ খুলে দিচ্ছে! সন্দেশখালি কাণ্ডে এবার তৃণমূলের পাশে কংগ্রেস]
দ্বিতীয়ত, আমেঠির পাঁচ বিধানসভা কেন্দ্রে একটা সময় সমাজবাদী পার্টির যে দখল ছিল, ক্রমেই তা কমেছে। ২০২২ সালে তিনটি কেন্দ্র গিয়েছে বিজেপির দখলে। তুলনায় রায়বরেলি অনেক সহজ কেন্দ্র। গত বিশ বছর ধরে সোনিয়া গান্ধীকে তারা আগলে রেখেছে। তৃতীয়ত, আমেঠিতে দঁাড়ালে তঁাকে হারাতে বিজেপি সর্বশক্তি নিয়োগ করত। সফল হতে যা-যা দরকার, সব করত। বিজেপি জিতে গেলে দল ও দেশে রাহুলের পাশাপাশি কংগ্রেসও আরও বেশি করে বেইজ্জত হত। চতুর্থত, জেতার জন্য রাহুলকে আমেঠিতেই পড়ে থাকতে হত মাটি কামড়ে। অন্যত্র প্রচারে যেতে পারতেন না। রায়বরেলির ক্ষেত্রে তেমন হবে না। ওই কেন্দ্রের অন্তর্গত পঁাচ বিধানসভার মধ্যে চারটিই সমাজবাদী পার্টির দখলে। গান্ধী পরিবারের প্রতি সেখানকার মানুষজন অনুগতও।
প্রিয়াঙ্কার উপর চাপ রাহুলের চেয়ে কম ছিল না। সবাই যেমন আমেঠিতে রাহুলকে চেয়েছিল, তেমনই চেয়েছিল সোনিয়ার ছেড়ে যাওয়া আসনে প্রিয়াঙ্কাই বসুন। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা তা চাননি। কারণ, তিনি মনে করেছেন, রায়বরেলি বা অন্য কোনও কেন্দ্র থেকে তঁার দঁাড়ানোর অর্থ বিজেপির হাতে থাকা পরিবারতন্ত্রর অস্ত্রে নতুন করে শান দিয়ে ধারালো করে তোলা। দ্বিতীয়ত, তিনি বুঝেছেন, দলের জন্য যে প্রচার আজ তিনি করতে পারছেন, ভোটে দাঁড়ালে তা পারবেন না। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর বক্তা প্রিয়াঙ্কা-ই। সব প্রার্থী তাঁকেই চান। মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্য, যেখানে কংগ্রেসের ভাঙন কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না, সেখানেও প্রিয়াঙ্কার কথা শুনতে লাখো মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। গুজরাত, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা কিংবা উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী জনসভাগুলো কংগ্রেসিদের আশান্বিত করে তুলছে। এর কৃতিত্ব পুরোটাই প্রিয়াঙ্কার।
এত ‘ফোকাস্ড’, এত আবেগ ও তীক্ষ্ণ-তীর্যক যুক্তি দিয়ে মোদির রাজনীতিকে এভাবে আক্রমণ তঁার মতো আর কোনও কংগ্রেস নেতা করতে পারছেন না। জনতার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে ‘কানেক্ট’ করতে পারছেন প্রিয়াঙ্কা। মোদির রাজনীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিচারধারার লড়াই তিনি যেভাবে বোঝাতে পারছেন, রাহুলও ততটা সফল হয়তো নন। এই পরিস্থিতিতে ভোটে দঁাড়ালে দলের পক্ষে তা লাভজনক হত না বলেই তঁার বদ্ধমূল ধারণা। সেখান থেকে কেউ তঁাকে টলাতে পারেনি।
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি যতই ক্ষুরধার হোক, যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। ওই সিদ্ধান্ত থেকে ফেরার কোনও উপায় আর নেই। কিন্তু এই সিদ্ধান্তই জন্ম দিয়েছে নতুন এক প্রশ্নের। সেই প্রশ্ন ঘিরে শুরু হয়ে গিয়েছে অন্য এক জল্পনা। রাহুল তো বটেই, কংগ্রেসকেও পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে অনেক ভেবেচিন্তে। তার উপর আগামী দিনের রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করবে।
[আরও পড়ুন: আস্থাভোট চাইলেন জেজেপির দুষ্মন্ত, হরিয়ানায় সংকট বাড়ল বিজেপির]
ধরে নেওয়া যেতেই পারে, ওয়েনাড ও রায়বরেলি দু’-জায়গা থেকেই রাহুল জয়ী হলেন বিপুল ভোটে। তারপর কী করবেন তিনি? একটা আসন তো ছাড়তে হবে? কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখবেন? ১৯৫২ ও ’৫৭ সালে পিতামহ ফিরোজ গান্ধী যে-রায়বরেলিতে জিতেছিলেন, সেটি, না কি কেরলের যে-কেন্দ্র তঁাকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি সম্মান রক্ষা করেছে, সেই ওয়েনাড? ভুললে চলবে না, আমেঠির জমি নরম হয়ে গিয়েছে বুঝেই রাহুল কিন্তু ওয়েনাডমুখী হয়েছিলেন। ওয়েনাড রাহুলের মর্যাদা রক্ষা করেছে। সেই ওয়েনাড ছেড়ে দিলে কংগ্রেসের পাশাপাশি রাহুলের ভাবমূর্তি নষ্ট তো হবেই, এখন যাদের দেশ ও গণতন্ত্রর পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করা হচ্ছে, সেই বিজেপির পায়ের তলার জমিও ওই রাজ্যে আরও পোক্ত হবে। বিজেপি এবার কেরলে খাতা খুলতে মরিয়া। ওয়েনাড ছাড়লে সেই প্রক্রিয়া দ্রুত বেগবান হবে।
সমস্যা অন্যত্রও। ২০২৬ সালে কেরল বিধানসভার ভোট। কংগ্রেস অবশ্যই চাইবে বামপন্থীদের হটিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে। সেই জমিও তৈরি। ওয়েনাড ত্যাগ করলে রাজ্য দখলের স্বপ্ন ধাক্কা খেতে পারে। সেই ঝুঁকি রাহুল নেবেন কি?
তার চেয়ে ঢের ভাল, রায়বরেলি ছেড়ে দিয়ে উপনির্বাচনে জেতার জন্য প্রিয়াঙ্কাকে এগিয়ে দেওয়া। দাক্ষিণাত্য আবার নতুন করে কংগ্রেসের গড়ে পরিণত হচ্ছে। সেখানে রাহুলের উপস্থিতি জরুরি। প্রিয়াঙ্কাও যাবতীয় জড়তা ও পিছুটান ঝেড়ে এগিয়েছেন। রায়বরেলি তঁাকেও বরণ করবে। তাছাড়া নির্বাচনী জনসভায় প্রিয়াঙ্কার ভাষণ শুনে নিঃসংকোচে বলা যায়, তঁাকে পেলে সংসদীয় গণতন্ত্র উপকৃতই হবে।