সামাজিক দ্বিচারিতার ভিতরে বেড়ে উঠতে-উঠতে আমরা দেখেছি নিয়মের বেলায় মেয়ে-পুরুষে বিস্তর ফারাক। সবচেয়ে বড় কথা, আধুনিকতার দায়ভাগে মেয়েরা ছিটেফোঁটা আধুনিক হলেও–তাদের শরীরটা ঠিক-ঠিক আধুনিকতার অংশ হল না। লিখছেন কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন।
ঠান্ডা ঘর। এসি চলছে। শীত-শীত লাগে। কত এসি একসঙ্গে চলছে? অনেক নিশ্চয়ই। চলারই তো কথা। এটা ঝকঝকে সেমিনার রুম। মঞ্চে মেধাজীবীরা। মহানগর অবশ্য পুড়ছে এই ঠান্ডা ঘরের বাইরে। খেটে-খাওয়া মানুষরা ঝলসানো শরীর নিয়ে ঝিমচ্ছে। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বক্তা বলছেন– ‘২০২৪ এটা। আমরা এখন এক গ্লোবালাইজ্ড আধুনিক পৃথিবীর বাসিন্দা। ইন্টারনেটের মহিমায় মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে দিচ্ছে আধুনিকতার সংজ্ঞা। মুছে যাচ্ছে আমাদের মধ্যেকার সীমারেখা, বিভেদ...।’ সত্যিই তো! আমরা এখন দারুণ মডার্ন! ঝাঁ চকচকে শপিং মলের চোখ-ধাঁধানো ব্র্যান্ডেড আউটলেটের মতো, তাক-লাগানো আকাশছোঁয়া স্কাই স্ক্র্যাপারের মতো, এসকালেটরে চড়ে হুসহুস করে বাধাবিপত্তিহীন উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠে যাওয়ার মতো। তার সঙ্গে আমাদের চারবেলার ধোপদুরস্ত আধুনিকতার দুর্দান্ত দোসর হয়েছে ইন্টারনেটের দুরন্ত গতি। কানেকশনে কেবল সংখ্যার-পর-সংখ্যা বাড়িয়ে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এবং প্রতি মুহূর্তের যাপনে ফাইভ জি যেন এই একুশ শতকীয় সভ্যতার আশ্চর্য প্রদীপ। কিন্তু তাতেও আমরা শান্তি পাচ্ছি না, শান্ত হতে পারছি না।
আধুনিকতার সঙ্গে গতির এক সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। সেই আদিম মানুষের চাকা আবিষ্কার থেকে এখনকার বিশ্বায়িত ভুবনে ‘ক্লোন মানব’ সৃষ্টি পর্যন্ত কথাটা সত্যি। তবে আধুনিকতার প্রশ্নে, গতি মানুষের চিন্তার চৌহদ্দি ও মানসিক কাঠামোয়, কতটা বিবর্তন আনছে– সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মগজে ও মননে আধুনিকতার বোধ গভীর না-হলে আধুনিকতার বাহ্য উচ্ছ্বাস দিয়ে কিছুই হওয়ার নয়। এবং আধুনিকতার এই টুকরোটাকরা অপরিণত উচ্ছ্বাসগুলিই সামাজিক স্ববিরোধের ক্ষেত্র তৈরি করে। না-হলে কেন এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েও মেয়েদের একদিন প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় হাজারও একটা শর্ত!
মহানগরে ঘটা হালফিলের একটি ঘটনা আমাদের লজ্জিত ও অধোবদন করেছে।কেন বারবার নারকীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয় মেয়েদের? বিশ্লেষণহীন বৈপরীত্যে এ কেমন স্ববিরোধের মতো হয়ে উঠছে না! আমরা মুখে দাবি করছি– আমরা এগিয়ে চলেছি, শতক ও দশকের সংকীর্ণ বেড়াজাল টপকে-টপকে আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, রুচিশীল হচ্ছি, যুক্তিবাদী হচ্ছি– অথচ আমাদের অন্তর্গত আদিম প্রবৃত্তি দানবের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদেরই ভিতরে। দারুণ নৈরাজ্যের সমান্তরাল পৃথিবী বেঁচেবর্তে থাকছে আমাদের পৃথিবীর পাশে– যেখানে হিংসা, ক্রোধ, লোভ, যৌনতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা সমাধান চাইছি, এসবের সমাধান চাইতে গিয়েই দ্বিধাহীনভাবে ছেঁটে দিতে চাইছি মেয়েদের ডানা। মেয়েদের সুরক্ষার প্রশ্নে কিছুদিন আগে বলা হয়েছিল– মেয়েরা রাত্তিরে কাজ করবে না। অদ্ভুত ও অসংগত কথা। সুপ্রিম কোর্টও প্রশ্নাতুর হয়েছিল! সুরক্ষার সঙ্গে রাত-ডিউটির কীসের টানাপোড়েন? ক্রনিক রোগের মতো শুশ্রূষাহীন স্ববিরোধ আমাদের সমাজের শরীরে-ব্যানারে, বিজ্ঞাপনে। বক্তৃতায় বড়-বড় করে উঠে আসছে নারী স্বাধীনতার কথা, নারীর মুক্তির কথা, তাদের এগিয়ে চলার কথা– অথচ বিপরীতে, বিস্ময়কর বিরোধাভাসে মেয়েদের জন্য রয়ে যাচ্ছে অজস্র প্রচ্ছন্ন ও প্রকট বিধিনিষেধের গণ্ডি অথবা লক্ষ্মণরেখা।
আধুনিকতার দায়ভাগে মেয়েরা ছিটেফোঁটা আধুনিক হলেও তাদের শরীরটা ঠিক-ঠিক আধুনিকতার অংশ হল না। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী বিপ্লব এল, অথচ মাথামোটা সমাজকে বোঝানো গেল না– মেয়েদের পিরিয়ডস হওয়া শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অতি স্বাভাবিক অংশ। সমাজ-সংসারে নারীকে ‘মা’ বলে পুজো করা হল, ‘প্রকৃতি’ বলে বেশ খানিকটা আদিখ্যেতাও করা হল, অথচ প্রকৃতিরই নিয়মে যখন সে ঋতুমতী, তখন সে অশুচি। যা কিছু শুভ ও মঙ্গল, তার বাইরে সে। কী কন্ট্রাডিকশন! শবরীমালা কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পরেও ছবিটা চারপাশে খুব বড় করে বদলেছে কি?
আদতে সমস্যা রয়েছে আমাদের চিন্তা ও চেতনার অনেক গভীরে– যেখানে যুক্তি ও বিচারের আলো পৌঁছতে পারে না, যেখানে ‘আধুনিকতা’ শব্দটির প্রায়োগিক মূল্য নেই। সামাজিক দ্বিচারিতার ভিতরে বেড়ে উঠতে-উঠতে আমরা দেখেছি নিয়মের বেলায় মেয়ে-পুরুষে বিস্তর ফারাক। মেয়েটি রাস্তায় বেরবে কিন্তু
গভীর রাতের রাস্তা তার জন্য নয়। মেয়েটি অফিসে যাবে, কিন্তু পরিপাটি সংসারের সবটুকু দায়ভার মিটিয়ে– তবে। মেয়েটি চাকরি করবে, উপার্জন করবে, কিন্তু নিজের পয়সায় নিজের পছন্দমতো পোশাক কিনে সে পরতে পারবে না। পরলে, মেয়েটি তার চাকরি খোয়াবে। র্যাঙ্ক করা চমৎকার ‘আধুনিক’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ছোট’ পোশাক পরে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার ‘বড়’ অপরাধে মেয়েটিকে তার শিক্ষকতার চাকরি থেকে বরখাস্ত করবে। এই কিন্তুগুলিই শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন তুলে দেয় যে, স্বাধীনতার জমকালো অমৃত মহোৎসবের পরেও অমৃতের কতটুকু মেয়েদের ভাগে এসে পড়ছে? আধুনিকতার সমুদ্রমন্থনের পরেও পুরুষতান্ত্রিকতার তীব্র গরল মেয়েদের এগিয়ে চলার বড় বাধা হয়ে রয়ে যাচ্ছে। এ তাদের জ্বালা-যন্ত্রণারও কারণ।
ভৌগোলিক মানচিত্রে পৃথিবীটা যেমন ভাগ হয়ে গিয়েছে, পৃথিবীর মানুষের আধুনিকতাতেও তেমনই পুবে ও পশ্চিমে ঢের ঢের ফারাক। আমরা এই কর্কটক্রান্তির ঠিকানায় থাকা মানুষরা এখনও বেশ পিছিয়ে আছি। কথায়-কথায় মডার্নিজমের তুখড় বুলি কপচানোর পরেও। সার্ত্র-সিমোনের জীবনবাস দেখার পরে, কাম্যু-কাজারেসের সম্পর্কের রসায়ন জানার পরে, ভার্জিনিয়া উল্ফের লেখা পড়ার পরেও আমরা আধুনিকতার মাত্রাগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা পাই এবং বুঝে নিতে পারি, কোন ফঁাকফোকরে আমাদের কতখানি গলদ। আমাদের আধুনিকতা কথায় যত বেশি, কাজে তার অনেকখানি কম। আমাদের আধুনিকতায় মিশে রয়েছে হিপোক্রেসি। ফলে, আমাদের আধুনিকতা পুষ্টতা ও পরিপূর্ণতা লাভ করছে না। আংশিক, খাপছাড়া হয়েই রয়ে যাচ্ছে।অল্প বিদ্যার মতো এ-ও কম ভয়ংকরী নয়।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক
krishnalakshmi269@gmail.com