প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও তাঁর বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমির আবদাল্লার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরেও কি তেহরানের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে? আমেরিকার অবস্থান কী হবে, তার উপরে কিন্তু অনেকটা নির্ভর করছে, ইরানের ভবিষ্যতের গতিপথ। লিখছেন সুমন ভট্টাচার্য।
পুরু আলেকজান্ডারকে উত্তর দিয়েছিলেন, একজন রাজা আরেকজন রাজার কাছ থেকে যে-ব্যবহার প্রত্যাশা করে, তিনিও তা-ই আশা করেন। ইরানের রাজনীতি কোন খাতে বইবে বা তেহরান কতটা কট্টরপন্থী থাকবে– তা-ও নির্ভর করছে আমেরিকা কীভাবে এশিয়ার এই ‘শিয়া পাওয়ার হাউস’ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করবে, তার উপরেই।
অর্থাৎ, ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পরে, এবং দেশের শীর্ষ নেতা হিসাবে আয়াতুল্লা খামেনেই-এর হাতে ক্ষমতার রাশ চলে যাওয়ার পরে, সেই দেশের সবচেয়ে উদারপন্থী নেতা হিসাবে হাসান রউহানি ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছিলেন এবং তিনি ইরানের জনগণকে যে-আশা দেখিয়ে পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা শুরু করেছিলেন; এবং যার ফলশ্রুতিতে– ২০১৫ সালে রউহানি এবং আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’-এ স্বাক্ষর করেছিলেন, তা ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বাতিল করে দেওয়ার পর থেকেই আবার ওয়াশিংটন এবং তেহরানের মধ্যে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলছে।
২০২১ সালে ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসার পর থেকে ইরান কার্যত কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণেই চলে গিয়েছে। তাই ২০২২ সালে মাহসা আমিনি-র মৃত্যুর পর হিজাব-বিরোধী আন্দোলন সারা ইরানকে কঁাপিয়ে দিলেও, গণতন্ত্রকামীরা মুক্তচিন্তার জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও, তেহরানের কট্টরপন্থী শাসকরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ঢিলে হতে দেননি। বরং, গত এক বছরে প্যালেস্টাইন নিয়ে একেবারে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিপ্রতীপ অবস্থানে থাকা ইরান সরাসরি ইজরায়েলের উপরে হামলা চালানোর ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়েছে। এমনকী, প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং তঁার বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমির আবদাল্লার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরও তেহরানের রাজনীতিতে কোনও পরিবর্তন আসবে, এমনটা আশা করে নেওয়া ভুল।
[আরও পড়ুন: কাশ্মীরে সরকারি চাকরি পাবে না জঙ্গি পরিবারের সদস্য, পাথর ছুড়লেও একই শাস্তি, হুঙ্কার শাহের]
অর্থাৎ, আমেরিকায় যদি অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটে এবং ট্রাম্পের মতো কেউ আবার প্রেসিডেন্টের পদে বসেন, তাহলে তেহরানও কট্টরপন্থা দিয়েই তার মোকাবিলা করবে। আর যদি খোদ মার্কিন মুলুকে আবার বারাক ওবামার মতো উদার এবং ‘শত্রুতা’-র বেড়া ডিঙিয়ে বন্ধুত্বের সেতু তৈরি করতে আগ্রহী কেউ আসেন, তাহলে ইরানের আপাত-রক্ষণশীল সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় আবার উদারপন্থীরা ভেসে উঠবে।
পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি বা মুসলিম বিশ্বকে যঁারা চেনেন, তঁারা মনে করেন, আসলে ইরানের রাশ যঁার হাতে, সেই আয়াতুল্লা খামেনেই তঁার প্রতিপক্ষ পশ্চিমের প্রতিক্রিয়া এবং প্রধান চরিত্রকে দেখে ঠিক করেন, তেহরানের হয়ে কে মাঠে নামবেন! ঠিক যেমন এখন রাইসি-র মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন আয়াতুল্লা খামেনেইয়ের ৫৫ বছর বয়সি পুত্র মোকবার খামেনেই। আমেরিকা বা ইউরোপের সঙ্গে ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক চলবে, তা বোধহয় ঠিক হবে, মার্কিন মুলুকে আগামী দিনে কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে আসবেন, তার উপর ভিত্তি করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির সঙ্গে ইরানের বিদেশমন্ত্রীর মৃত্যুর পর আপাতত পররাষ্ট্র দফতর যঁাকে সামলাতে বলা হয়েছে, সেই আলি বাঘেরি কানি আসলে খামেনেইয়ের জামাতার ভাই। এই বাঘেরি নিহত হোসেন আমির আবদাল্লার সহকারী ছিলেন, এবং শুধু যে সহকারী ছিলেন তা-ই নয়, গত কয়েক বছর ধরেই ইরান তার পরমাণু শক্তি ব্যবহার নিয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকার সঙ্গে যে-আলোচনা চালাচ্ছিল– তার মুখ্য মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। তাই একদিক থেকে বাঘেরি ‘অন্তর্বর্তী বিদেশমন্ত্রী’-র দায়িত্ব পাওয়াটা যতটা স্বাভাবিক, ঠিক তেমনই আমাদের বুঝতে হবে যে, তিনি সে-দেশের ‘সুপ্রিম লিডার’ বা শীর্ষ নেতার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না।
[আরও পড়ুন: ‘বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ’, রাহুল-কেজরির পাক যোগ নিয়ে দাবি মোদির]
অর্থাৎ, আয়াতুল্লা খামেনেই যত দিন বেঁচে আছেন, তিনি যে পথে ইরানকে নিয়ে যেতে চাইবেন, তা-ই হবে। আমেরিকায় বারাক ওবামা প্রেসিডেন্টের পদে বসার পর যেভাবে ‘শত্রু’ কমিয়ে বন্ধু বাড়ানোর দিকে উদ্যোগী হয়েছিলেন, যেভাবে তিনি এমনকী, ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবার সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে নিশ্চয়ই ইরানের শীর্ষ নেতা মনে করেছিলেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্কের শৈত্য কাটানোর সময় এসেছে। তাই ২০১৩ এবং ২০১৭-য় হাসান রউহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতেন। ২০১৩-র ইরানের নির্বাচনে রউহানির যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, সেই সৈয়দ জালিলির ঘনিষ্ঠতম সহযোগী ছিলেন বর্তমান বিদেশমন্ত্রী আলি বাঘেরি কানি। রউহানির জমানায় বাঘেরি কানির মতো কট্টরপন্থী অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। কারণ, সেই সময় হয়তো খামেনেই চেয়েছিলেন, ইরান উদারনীতির পথে হঁাটুক, পশ্চিমের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে দিক। সেজন্যই ২০১৫ সালে ওয়াশিংটন এবং তেহরানের মধ্যে ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল।
আবার, যেই আমেরিকায় দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হয়েছে, ইরানও আস্তে আস্তে খোলসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। বিশেষ করে ২০২০-তে ইরাকে ট্রাম্পের নির্দেশে ড্রোন হামলায় তেহরানের সবচেয়ে বিখ্যাত সেনা অফিসার কাসেম সোলেমানির মৃত্যুর পর থেকে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র এক নতুন পর্ব শুরু হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কাসেম সোলেমানি শুধু আয়াতুল্লা খামেনেইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সামরিক কর্তা ছিলেন না, পশ্চিম এশিয়ায় আইএস-কে নিকেশ করতে তিনি মার্কিন সেনার সঙ্গে কঁাধে কঁাধ মিলিয়ে লড়েছিলেন। আমেরিকার অতি-দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে সেই সোলেমানিকে যখন ইরাকে হত্যা করা হয়, তখন তেহরান এই ঘটনাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসাবেই দেখেছিল।
কাসেম সোলেমানির মৃত্যুর পরের বছর, ২০২১ সালে, ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট পদে বসেন এবং আস্তে আস্তে ইরানের রাজনীতির পরিসর বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে নরমপন্থীরা হটে যায়। গত বছর হামাস বনাম ইজরায়েলের সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান আরও কট্টরপন্থার দিকে পা বাড়িয়েছে।
পশ্চিম এশিয়া এবং আরব মুলুকে তাদের যে ‘অ্যাক্সিস অফ রেজিস্ট্যান্স’ বা বিভিন্ন প্রতিস্পর্ধী গোষ্ঠী রয়েছে– যেমন লেবাননে হিজবুল্লা, ইয়েমেনে হাউতি বা প্যালেস্তাইনে হামাস গোষ্ঠী– তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। একদিকে আমেরিকা এবং ইজরায়েল, অন্যদিকে ইরান– এই যে দুই শিবির ছিল, এবং যে-শক্তিবিন্যাসে তেহরান কিছুটা দুর্বলই ছিল, সেখানে ওয়াশিংটনের চির-প্রতিদ্বন্দ্বী মস্কো এবং বেজিং পাশে দঁাড়ানোয় ‘পাওয়ার অফ ব্যালেন্স’ এবার বদলে গিয়েছে। চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কৌশলে ‘শিয়া’ ইরানের সঙ্গে ‘সুন্নি’ সৌদি আরবের বন্ধুত্ব স্থাপিত হওয়ায় পশ্চিম এশিয়ার বা মুসলিম দুনিয়ায় রাজনীতিও বদলে বইকি।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে ইরান এবং সৌদি আরব ছাড়া মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ তুরস্ক আমেরিকার প্রতিস্পর্ধী অবস্থানেই রয়েছে। তাই হামাস-ইজরায়েল সংঘাত শুরু হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যতই নেতানিয়াহু-র পাশে দঁাড়ান, হামাসের ‘সমর্থনকারী’ বলে পরিচিত ইরানও তার বন্ধু বাড়িয়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর একেবারে বিপ্রতীপ অবস্থানে চলে যাওয়া ইরান আপাতত কট্টর অবস্থান থেকে সরবে– এমন কোনও ধারণা করা উচিত নয়।
[আরও পড়ুন: আরও বাড়ল গরমের ছুটি, কবে খুলবে স্কুল?]
রাইসি-র মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ, জুনের শেষ দিকে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের নাম আমরা জানতে পারব। তিনি আয়াতুল্লা খামেনেইয়ের পুত্র হন বা অন্য কেউ, তেহরান তার রাজনৈতিক রাস্তা বদলাবে, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই– আমরা তা ইতোমধ্যে বলেছি। আর যদি আমেরিকা বা ইউরোপে অতি-দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হয়, বা ইসলাম-বিদ্বেষ মাথাচাড়া দেয়, যেমনটা আমরা সম্প্রতি বেলজিয়ামের নির্বাচনে দেখেছি, তাহলে ইরানও কট্টরপন্থী হবে। আমেরিকায় মুক্তমনাদের দাপট দেখা দিলে হয়তো তেহরানও হাতের দড়িকে শিথিল করতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সেখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে তুমুল বিক্ষোভ অনেক ধরনের রাজনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলাফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।