নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে এই প্রথম পরিবারের মাসিক খরচ নিয়ে সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হল। দাবি করা হয়েছে, দেশে চরম দারিদ্র নাকি অনেকটাই কমে গিয়েছে। প্রায় দুই শতাংশের কাছাকাছি। পরিসংখ্যানে যাই দাবি করা হোক, দেশের বাস্তব অবস্থার কথা সকলেরই জানা। লোকসভা ভোটের আগে এই রিপোর্ট প্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কৌশল নয় তো? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
পরিবারের মাসিক খরচ নিয়ে সমীক্ষার রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে এই ধরনের সমীক্ষার রিপোর্ট প্রথম প্রকাশ করা হল। লোকসভা ভোটের আগে এই রিপোর্ট প্রকাশের পিছনে মোদির (PM Modi) রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে বিরোধীরা ইতিমধ্যে সমালোচনা শুরু করেছে। কারণ এই রিপোর্টের মধ্য দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে, দেশে চরম দারিদ্র অনেকটাই কমে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই রিপোর্ট প্রকাশের পরে পরেই একটি মার্কিন সংস্থা দাবি করেছে, ভারতে চরম দারিদ্র মাত্র দুই শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে।
তথ্য পরিসংখ্যানে যা-ই দাবি করা হোক, দেশের বাস্তব অবস্থার কথা সকলেরই জানা। দেশের সমস্ত শহরেই এখনও অসংখ্য মানুষের দেখা পাওয়া যায়, যারা ফুটপাতে বাস করে। যাদের মাথার উপর এখনও ছাদ নেই। ভারতে এইরকম চরম দারিদ্রে পড়ে থাকা মানুষের সংখ্যা কীভাবে জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ হয়, তার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ভোটের আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থার এই ধরনের রিপোর্টকে রাজনৈতিক প্রচারের বেশি মূল্য দিতে বিরোধীরা নারাজ।
[আরও পড়ুন: অবতরণের সময় ককপিটে চোখ ধাঁধানো লেজার লাইট! দমদম বিমানবন্দরে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা]
পারিবারিক মাসিক খরচের এই সমীক্ষা থেকে কী উঠে এসেছে, সেটা দেখাও অবশ্য জরুরি। ২০২২-এর আগস্ট মাস থেকে ২০২৩-এর জুলাই মাস পর্যন্ত এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। দেশের মোট ৮৭২৩টি গ্রাম ও ৬১১৫টি শহরে এই সমীক্ষা চলেছে। গ্রাম ও শহর মিলিয়ে মোট ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৪৬টি পরিবারে সমীক্ষাটি চলে। এই পরিবারগুলির মধে্য ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ১৪টি পরিবার গ্রামে বাস করে এবং ১ লক্ষ ৬ হাজার ৭৩২টি পরিবার শহরাঞ্চলে বাস করে। গ্রামীণ পরিবারগুলির মাসে গড় খরচের পরিমাণ ৩৮৬০ টাকা এবং শহরের পরিবারগুলির মাসিক গড় খরচের পরিমাণ ৬৫২১ টাকা। খুব স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে গ্রাম ও শহর, উভয়ক্ষেত্রেই পারিবারিক খরচ তুলনামূলকভাবে উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির চেয়ে বেশি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি পারিবারিক খরচ সিকিমে। সিকিমের গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলি দেশের অন্যান্য যে কোনও রাজে্যর পরিবারের তুলনায় মাসে বেশি টাকা খরচ করে। সিকিমের এই আর্থিক উন্নতি পর্যটন ব্যবসার দৌলতেই এসেছে কি না, তা সমীক্ষা করে দেখার বিষয়।
২০১১-’১২ সালে তৎকালীন যোজনা কমিশন দারিদ্র পরিমাপ করার জন্য সুরেশ তেণ্ডুলকরের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করেছিল, তারা বলেছিল গ্রামাঞ্চলে যেসব ব্যক্তি মাসে ৮১৬ টাকা এবং শহরাঞ্চলে হাজার টাকার কম অায় করে, তারা দারিদ্রসীমার নিচে। ২০১১-’১২ সালের পর থেকে গত প্রায় এক যুগে ভয়ংকর পরিমাণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এই মূল্যবৃদ্ধিকে বিবেচনায় রাখলে ২০১১-’১২-র নিরিখে পরিবারের খরচ দেখে কোনওভাবেই বলা সম্ভব নয় যে, দেশের কত শতাংশ দারিদ্রমুক্ত হয়েছে। ২০১১-’১২-র মাপকাঠিতে তেন্ডুলকর কমিটি বলেছিল শহরে ১৩.৭ শতাংশ ও গ্রামে ২৫.৭ শতাংশ, সব মিলিয়ে ২১.৯ শতাংশ মানুষ দেশে দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। একটি পরিবারের গড়ে পঁাচজন সদস্য রয়েছে ধরা হলে দারিদ্রসীমার নিচে থাকতে হলে মাসিক ব্যয় গড়ে ৪০৮০ টাকা দরকার। কিন্তু গ্রামীণ পরিবারগুলির গড় মাসিক ব্যয় এখনও ৩৮৬০ টাকা। তাহলে তেন্ডুলকর কমিটি গ্রামে যে ২৫.৭ শতাংশ চরম দারিদ্র হিসাব করেছিল, তার থেকে দেশ এগোল কীভাবে? পারিবারিক ব্যয়ের হার দেখে তো মনে হচ্ছে গ্রামে গত একদশকে দারিদ্র অারও বেড়েছে। শহরে অবশ্য পারিবারিক ব্যয় দারিদ্রসীমার মাপকাঠি বিচার করে একদশকে কিছুটা বেড়েছে।
[আরও পড়ুন: লক্ষ্য প্রত্যেক শহরে শাখা স্থাপন, সমবায় ব্যাঙ্কের যৌথ সংগঠন NUCFDC-র উদ্বোধন অমিত শাহর]
পারিবারিক খরচ কোন পণে্যর উপর ঘটছে, তা দিয়েও দারিদ্র কমার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া চেষ্টা চলছে। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামে ও শহরে একেকটি পরিবারের খাদ্যপণ্যর পিছনে মাসিক খরচ গত একদশকের তুলনায় অনেকটাই কমে গিয়েছে। বর্তমান সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশের একেকটি গ্রামীণ পরিবার তাদের মাসিক খরচের ৪৬ শতাংশ করে খাদ্যপণ্যর জন্য এবং ৫৪ শতাংশ করে খাদ্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণে্যর জন্য। শহরাঞ্চলে একেকটি পরিবার বর্তমানে খাদ্যপণ্যর উপর খরচ করে ৩৯ শতাংশ, এবং অন্যান্য পণ্যর উপর খরচ করে ৬১ শতাংশ। একটি পরিবার যখন তার মোট পারিবারিক ব্যয়ের কম অংশ খাদ্যপণ্যর উপর খরচ করে, তখন বোঝা যায় যে, তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে। আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটলেই কোনও পরিবারে খাদ্যপণ্যর উপর ব্যয় কমে। বঁাচার জন্য অাগে মানুষকে খেতে হয়। খাওয়া পর্যাপ্ত হলে তবেই মানুষ অন্যান্য পণে্য খরচ বাড়ায়।
১৯৯৯-২০০০ সালে জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর যে পারিবারিক খরচের সমীক্ষা চালিয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল, গ্রামীণ পরিবারগুলি খাদ্যপণে্য খরচ করত ৫৯.৪০ শতাংশ। ২০১১-’১২ তে সেটা কমে ৫২.৯০ শতাংশ হয়। ২০২২-’২৩-এ সেটা কমে ৪৬.৩৮ শতাংশ হয়েছে। ১৯৯৯-২০০০-এর সমীক্ষায় শহরে বসবাসকারী একেকটি পরিবার তাদের মাসিক ব্যয়ের ৪৮.০৬ শতাংশ খাদ্যপণে্য ব্যয় করত। ২০১১-’১২-তে সেটা কমে হয়েছিল ৪২.৬২ শতাংশ। ২০২২-’২৩-এ সেটা আরও কমে ৩৯.১৭ শতাংশ। এই খাদ্যপণ্যর খরচের মধে্য চাল, ডাল, গম ইত্যাদি খাদ্যশস্যর পিছনে পরিবারগুলির খরচ আরও কমছে। ১৯৯৯-২০০০ সালে গ্রামে একেকটি পরিবার খাদ্যশস্য কিনতে খরচ করত খাদ্যপণ্যর পিছনে মোট ব্যয়ের ২২.২৩ শতাংশ, শহরে এটা ছিল ১২.৩৯ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গ্রামে চাল-গম-চিনি-তেলের পিছনে খরচের পরিমাণ কমে ৬.৯২ শতাংশ হয়েছে এবং শহরে ৪.৫৮ শতাংশ হয়েছে। চাল, ডাল, গম, চিনি ইত্যাদি সিরিয়ালজাত পণ্যর পিছনে ব্যয়ের শতাংশ কমে যাওয়াও আর্থিক প্রগতির ইঙ্গিত করে। কারণ এর থেকে বোঝা যায় পরিবার দুধ-ডিম-মাছ-মাংস ইত্যাদিতে খরচ বাড়াচ্ছে। তাছাড়া লকডাউনের সময় থেকে দেশের ৮১ কোটি মানুষ বিনামূলে্য চাল, গম পাচ্ছে। সে-কারণে গত একদশকে খাদ্যশস্যর উপর দেশের পরিবারগুলির খরচ দ্রুতহারে কমেছে।
দেশের পরিবারগুলির মাসিক খরচে যেমন খাদ্যপণ্য এবং খাদ্যশস্য জাতীয় পণ্যর ভাগ দ্রুতহারে কমছে, তেমন স্বাস্থ্য ও যাতায়াতের খরচ দ্রুতহারে বাড়ছে। এখন একেকটি পরিবারে মোট খরচের চিকিৎসার খরচ গ্রামে ৭.১৩ শতাংশ ও শহরে ৫.৯১ শতাংশ। যাতায়াতের খরচ গ্রামে ৭.৫৫ শতাংশ ও শহরে ৮.৫৯ শতাংশ। পেট্রোল-ডিজেলে দাম বাড়ার জন্য যাতায়াত খরচ বাড়ছে। সবমিলিয়ে গ্রামে খাদ্য ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের খরচ মাসিক খরচের ৫৩.৬২ শতাংশ এবং শহরে ৬০.৮৩ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে এই প্রবণতা যবে থেকে পারিবারিক খরচের সমীক্ষা শুরু হয়েছে, তবে থেকেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সমীক্ষা থেকে কোনওভাবেই এটা প্রতীয়মান হয় না যে, দারিদ্র কমে যাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে হিসাবে রাখলে দেখা যাবে, গত একদশকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পারিবারিক ব্যয় মোটেও সেভাবে বাড়ছে না। সাদা চোখে অামরা দেখতে পাই ভারতের ধনসম্পদ ক্রমশ অল্পসংখ্যক মানুষের হাতেই পুঞ্জীভূত হচ্ছে। দারিদ্র কমার বিষয়টি বিচার করতে গেলে তা এই আর্থিক অসামে্যর নিরিখেই করতে হবে। কিন্তু সেই ধরনের কোনও সমীক্ষা এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে না। খালি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা চলছে।