shono
Advertisement
Municipalities

নতুন কর প্রণয়নের সুযোগ পাক পুরসভাগুলি

আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্টে শহরগুলির স্বাধীনভাবে অর্থ সংস্থানের প্রয়োজনীয়তার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
Published By: Biswadip DeyPosted: 02:23 PM Aug 29, 2024Updated: 02:23 PM Aug 29, 2024

৭৪তম সংবিধান সংশোধনীর ১২তম অনুসূচি অনুযায়ী, দেশের পুরসভাগুলির জন্য নির্দিষ্ট কাজের তালিকা থাকলেও সেগুলি নির্বাহ করার জন্য সুস্পষ্ট আয়ের তালিকা নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অনুদান বড় ভরসা। এই নিয়মে কি পরিবর্তন আনা যায়? লিখলেন সৌম্যদীপ চট্টোপাধ্যায়

Advertisement

এই বছরের বাজেটে সরকার-চিহ্নিত ন’টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে অন্যতম হল– ‘নগরোন্নয়ন’। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্ট (২০২২) অনুযায়ী, আগামী ১৫ বছরে আমাদের দেশের শহরগুলিতে ৮৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার, যার মধ্যে শুধুমাত্র জল এবং নিকাশি ব্যবস্থার পরিকাঠামো তৈরি করার জন্য প্রয়োজন ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। প্রতি বছর বাজেটে নগরোন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তা বিনিয়োগের ঘাটতি মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্টে (২০২৩-’২৪) শহরগুলির স্বাধীনভাবে অর্থ সংস্থানের প্রয়োজনীয়তার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

কিন্তু সমস্যা হল: অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো ভারতেও শহরগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য বেশ খারাপ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট (২০২২) অনুযায়ী, ২০১৭-’১৮ থেকে ২০১৯-’২০ সময়ের মধ্যে পুরসভাগুলির মোট আয় জিডিপির ০.৬৫ শতাংশের আশপাশে থেকেছে। যেখানে ব্রাজিল বা সাউথ আফ্রিকার মতো দেশে এই অনুপাতটি ৬ থেকে ৭.৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। উল্লেখ্য, ভারতে পুরসভাগুলির মোট আয়ের একটা বড় অংশ আসে– কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অনুদান মারফত। ২০১৭-’১৮ আর্থিক বছরে পুরসভাগুলির মোট আয়ের মাত্র ৪২ শতাংশ এসেছিল নিজস্ব আয় থেকে। ছোট এবং মাঝারি শহরগুলির ক্ষেত্রে নিজস্ব আয় থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ আরও কম।

[আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ভাঙচুরের ছক! গ্রেপ্তার ৩]

প্রশ্ন হল, ভারতে পুরসভাগুলি আর্থিকভাবে সক্ষম হয়ে উঠতে পারল না কেন? এর উত্তর পেতে হলে বুঝতে হবে পুরসভাগুলির হাতে কী ধরনের আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে! ৭৪তম সংবিধান সংশোধনীর ১২তম অনুসূচি অনুযায়ী, পুরসভাগুলির জন্য নির্দিষ্ট কাজের তালিকা থাকলেও সেগুলি নির্বাহ করার জন্য সুস্পষ্ট আয়ের তালিকা নেই। পুরসভার কাছে থাকা করের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল ‘সম্পত্তি কর’। সংবিধানের রাজ্য তালিকার সপ্তম অনুসূচি অনুযায়ী– রাজ্য সরকারের স্থির করে দেওয়া সম্পত্তি মূল্যায়ন ও করহারের সাপেক্ষে পুরসভা তার ‘সম্পত্তি কর’ নির্ধারণ করে। ভারতে বেশিরভাগ পুরসভায় ‘সম্পত্তি কর’ নির্ধারিত হয় কোনও সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত সম্ভাব্য বার্ষিক ভাড়ার ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থায় কর-নির্ধারকদের মর্জিমাফিক সম্পত্তি মূল্য নির্ধারণের সুযোগ থাকায়– সম্পত্তি সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই পদ্ধতিতে ঠিক করা ‘সম্পত্তি-মূল্য’ বাজার চলতি ‘সম্পত্তি-মূল্য’-র মাত্র ৮-১০ শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত করসংগ্রহ ও বহুরকম কর ছাড়ের সমস্যা। ভারতে শহরের মোট সম্পত্তির প্রায় ১০ শতাংশ এবং মূল্যায়িত সম্পত্তির প্রায় ১১ শতাংশ কর ছাড়ের সুবিধা রয়েছে। ‘সম্পত্তি কর’ থেকে পুরসভাগুলির প্রাপ্ত আয় তাই কখনওই আশানুরূপ হয় না।

‘সম্পত্তি কর’ ছাড়া আর সেরকম কোনও পুর-কর নেই– যেগুলি ব্যবহার করে পুরসভা তাদের আয়ের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। এর একটা কারণ, রাজ্য সরকারগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্পদ হারানোর ভয়ে বিভিন্ন কর– যেমন: পেশা-কর, বিজ্ঞাপন-কর আদায় করার ভার পুরসভাগুলির হাতে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেনি। Octroi বা বিভিন্ন জিনিসপত্র শহরে আনার করের (প্রবেশ্য) মতো উচ্চ-আয় সৃষ্টির ক্ষমতাসম্পন্ন কর বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যেমন, মহারাষ্ট্রে পুরসভাগুলি আর্থিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী ছিল। এই রাজ্যে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনগুলির নিজস্ব আয়ের সিংহভাগই আসত Octroi বা প্রবেশ্য কর থেকে। তা সত্ত্বেও বাতিল হয়ে যাওয়া Octroi-এর পরিবর্তে অনুরূপ কোনও কর বা অন্য কোনওরকম অনুদানের ব্যবস্থা মহারাষ্ট্র করেনি। ‘লাইসেন্স ফি’ বা ‘পার্কিং ফি’-র মতো করকেও সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। নাগরিক পরিষেবার জন্য বেশির ভাগ পুরসভায় পরিষেবা-ভিত্তিক কোনও কর নেওয়া হয় না।

[আরও পড়ুন: তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ষড়যন্ত্রে তিন! সিবিআইয়ের রাডারে কারা?]

‘জিএসটি’ চালু হওয়ার পরে পুরসভাগুলির আর্থিক স্বাধীনতা আরও কমেছে। নানা ধরনের কর– যেমন: Octroi, entertainment ট্যাক্স জিএসটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একই সঙ্গে জিএসটি চালু হওয়ার পরে নাগরিক পরিষেবা রক্ষণাবেক্ষণের খরচও বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘The Constituional Amendment Act 2016’ অনুযায়ী, জিএসটি চালু করার জন্য রাজ্য সরকারের আর্থিক ক্ষতি হলে কেন্দ্রীয় সরকারের সেই ক্ষতি পূরণ করে দেওয়ার কথা। কিন্তু, পুরসভার অনুরূপ আর্থিক ক্ষতি মেটানোর কোনও আইনি নির্দেশ রাজ্য সরকারকে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের নগরোন্নয়ন দফতর ২০১৫ সালে রাজ্যের জিএসটি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ২৫ শতাংশ পুরসভাগুলিকে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল– যদিও তা মানা বা কার্যকর করা হয়নি। পুরসভাগুলির আর্থিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্টে (২০২৩-’২৪) ‘মিউনিসিপ্যাল বন্ড’ এবং শহর পরিকাঠামো তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য শহরের আর্থিক খতিয়ান অবশ্য অন্য কথা বলছে। এসব শহরের মোট আয়ের ৮০ শতাংশই আসে নিজস্ব আয় এবং সরকারি অনুদান থেকে। ‘মিউনিসিপ্যাল বন্ড’ ও যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পের অবদান নিউ ইয়র্কের মোট আয়ের ৬ শতাংশ, লন্ডন এবং সাংহাইয়ের ক্ষেত্রে যে-অনুপাতের মান– ১৩ ও ১৮ শতাংশ।

আসলে মূল বিষয়টি হল, কোনও উদ্ভাবনী পরিকল্পনা মৌলিক নিয়মের পরিপূরক কখনওই হতে পারে না। ভারতে পুরসভাগুলির আয়ের ঘাটতির যা বহর, তার প্রেক্ষিতে সবথেকে বেশি প্রয়োজন পুরসভাগুলির আর্থিক ক্ষমতায়ন। তার দু’টি উপায় রয়েছে– পুরসভাগুলির কাছে থাকা করের সঠিক ব্যবহার এবং পুরসভাগুলিকে নতুন কিছু কর প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান। পুর-করের হার নির্ধারণ ও কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুরসভাকে রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী চলতে হয়। তাই প্রয়োজন হল, করহার নির্ধারণ ও কর-সংগ্রহের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সুস্পষ্ট পুর আইনের মাধ্যমে পুরসভাগুলিকে দিয়ে দেওয়া।

‘সম্পত্তি কর’ নির্ধারণ ও সংগ্রহের ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি, যাতে করদাতারা সহজেই কত কর দিতে হবে এবং ঠিক কীভাবে তা নির্ধারিত হল, তা বুঝতে পারেন। কর নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পরে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর, করহারের পুনর্মূল্যায়ন দরকার। ‘Geographic Information System’ (GIS) ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত ধরনের সম্পত্তিকে করের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভবপর। অনলাইন ব্যবস্থার সাহায্যে করপ্রদানের প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তোলা যেতে পারে।

ভারতে অধিকাংশ শহরে নাগরিক পরিষেবা প্রদানের জন্য কোনও ব্যবহার-মূল্য আরোপ করা হয় না। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে, সাধারণ মানুষ– বিশেষ করে যারা দরিদ্র– তাদের পক্ষে ব্যবহার-মূল্য দেওয়া সম্ভব নয়, বা তারা ব্যবহার-মূল্য দিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যদি সমস্ত নাগরিক পরিষেবা– যেগুলি পরিমেয় এবং ব্যবহারকারীদের চিহ্নিতকরণ সম্ভব (যেমন: জল সরবরাহ, জঞ্জাল অপসারণ প্রভৃতি), সেসব প্রদানের জন্য যা খরচ তার ভিত্তিতে ব্যবহার-মূল্য চালু হওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল মানুষের আর্থিক ভার লাঘবের জন্য ভরতুকির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
পুরসভাগুলি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠলেই বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত উৎসগুলি থেকে (যেমন: মিউনিসিপ্যাল বন্ড) আয় বাড়ানোর সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখা সহজ হবে, এবং একই সঙ্গে শহর পরিকাঠামো ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বেসরকারি ক্ষেত্রের কাছে লাভজনক বিনিয়োগ হিসাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। ফলে পুরসভাগুলির কাছ থেকে উন্নততর পরিষেবা পাওয়ার সম্ভাবনা সুনিশ্চিতভাবেই আরও জোরালো হবে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অর্থনীতির অধ্যাপক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ৭৪তম সংবিধান সংশোধনীর ১২তম অনুসূচি অনুযায়ী, দেশের পুরসভাগুলির জন্য নির্দিষ্ট কাজের তালিকা থাকলেও সেগুলি নির্বাহ করার জন্য সুস্পষ্ট আয়ের তালিকা নেই।
  • কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অনুদান বড় ভরসা।
  • এই নিয়মে কি পরিবর্তন আনা যায়? উঠছে প্রশ্ন।
Advertisement