প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অঙ্গ হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষর কাছে ‘খোলা চিঠি’ লেখা মান্য রীতি। এখানে গোপনতা নয়, প্রকাশমানতা কাম্য।
“‘ফ্রান্স হ্যাজ দিস স্টেন আপ্ন হার চিক।’ কলঙ্কের দাগ পড়ে গেল ফ্রান্সের গালে। ইতিহাসে লেখা থাকবে যে আপনার শাসনকালে এমন একটি সামাজিক অপরাধ সংগঠিত হয়েছে।... চোখে জল নিয়ে, কণ্ঠে আওয়াজ ধারণ করে, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাইছি। একজন সাধারণ মানুষ এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে! আপনাকে বলতে চাইছি, কারণ, বিশ্বাস করি, আপনি বিষয়টি সম্পূর্ণ অবগত নন। আপনি এ-দেশের ফার্স্ট ম্যাজিস্ট্রেট, আপনিই সর্বেসর্বা, তাই আপনার দরবারে যদি প্রকৃত বিদ্বেষপরায়ণ ও অপচিকীর্ষু মানুষগুলিকে ভর্ৎসনা না-করি, তাহলে আর কোথায় করব বলুন?”
১৮৯৮ সালের ১৩ জানুয়ারি এই ‘খোলা চিঠি’ লিখেছিলেন বিশিষ্ট ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলা– “L’Aurore” খবরের কাগজের প্রথম পাতায়– ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স ফোরের উদ্দেশে। সেই খোলা চিঠির নাম: ‘আই অ্যাকিউস’। গুপ্তচর-বৃত্তির অপরাধে ফরাসি সেনাবাহিনীর আধিকারিক আলফ্রেড দ্রেফুসকে অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। এরই প্রতিবাদে কলম ধরেন এমিল জোলা। সরাসরি পত্রাঘাত করেন ফরাসি প্রেসিডেন্টকে। গণতান্ত্রিক পরিসর, মতাপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিল্পীর আপসহীন রাজনৈতিক সত্তা এবং নির্মম সমালোচনার ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত রূপে বিবেচিত হয় এই ‘খোলা চিঠি’।
‘খোলা চিঠি’ শব্দবন্ধটি আসলে বৈপরীত্যে ভরা। চিঠি বলতে আমরা সচরাচর এমন লেখ্য-কাঠামো বুঝি, যা গোপনীয়তার শর্ত রক্ষা করে চলবে। চিঠি হতে পারে কর্মস্থল-সংক্রান্ত। চিঠি হতে পারে ব্যক্তিগত। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই চিঠির বিষয়বস্তুকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ্য করে তোলার ব্যাপারে আলগা নিষেধাজ্ঞা থাকে, অনেকটা বিধিসম্মত সতর্কীকরণের মতো। আমরা ধরে নিই, চিঠির প্রাপক যিনি, আর চিঠি যিনি লিখছেন, তাঁদের মধ্যেই সীমিত থাকবে চিঠির মূল বক্তব্য। চিঠি যদি হয় ব্যক্তিগত, তাহলে তো গোপনতার শর্তটি আরও কড়াভাবে প্রযুক্ত হয়। তাই অন্যের ব্যক্তিগত চিঠি, সে-ব্যক্তিকে না জানিয়ে পড়া, নীতিগতভাবে অন্যায়। চিঠির মাধ্যমে এইভাবে ‘প্রাইভেট স্পেস’ বা ‘ব্যক্তিগত পরিসর’-এর ধারণা তৈরি হয়েছে।
‘খোলা চিঠি’-র ব্যঞ্জনা পুরো ভিন্ন। সে-চিঠি কোনও ব্যক্তিবিশেষকে লক্ষ্য করে লেখা হলেও– বিষয়বস্তুকে জনপরিসরে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ খোলা চিঠি গোপনতা মেনে চলার শর্তটিকে উপেক্ষা করে, বৃহত্তর স্বার্থের যুক্তি প্রদর্শন করে। যেমন, এমিল জোলা যে ‘খোলা চিঠি’ লিখেছিলেন দেশের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে, সেটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করার অর্থ– যাতে আরও অনেকে পড়তে পারেন। প্রতিবাদের মশাল যাতে আরও উজ্জ্বল হয়। এরিক কফম্যানের মতো তাত্ত্বিক এই কারণে ‘খোলা চিঠি’-র মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভঙ্গির প্রকাশ লক্ষ করেছেন– প্রতিবাদের আড়ালেই।