বস্তু খাওয়া থেকে লগ্নি-সব কাজেই আসে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। বস্তু বলুন অথবা দ্রব্য কিংবা ‘কমোডিটি’-এতে বিনিয়োগ করেও লাভের মুখদর্শন করা যায়। পোর্টফোলিওকে যদি ‘ডাইভারসিফায়েড’ করতে চান, তাহলে আপনার জন্য ‘কমোডিটি ফিউচার মার্কেট’-এ লগ্নি হতে পারে লাভজনক এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। গোটা বিষয়ে আলোকপাত করলেন শান্তনু গাঙ্গুলি
আপনি আলু খান, সোনা রুপোর গহনা পরেন, তামার পাত্রে জল রাখেন, কিন্তু জানেন কী, এইসব দ্রব্যে (কমোডিটি) বিনিয়োগ করে লাভ করা যায় ঠিক শেয়ার বা বন্ড-এ বিনিয়োগের মতো? আপনি হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন, আমি বলতে চাইছি শেয়ার-এর মতো সোনা বা রুপো কম দামে কিনে পরে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ ঘরে তোলার কথা। এটা আপনি করতেই পারেন, কিন্তু আমি যেটা বলছি সেটা একটু আলাদা। ব্যাপারটা আরও একটু খোলসা করে বলি।
কমোডিটিতে ফরওয়ার্ড ট্রেডিং ব্যাপারটা বহুদিন প্রচলিত। আজ ১৫ নভেম্বর ২০২১, ধরা যাক একজন আলুচাষি আন্দাজ করলেন তার খেতের আলু জানুয়ারি ২০২২-এ বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু ধরুন তখন আলুর ফলন অনেক হবে, ফলে তিনি ভাবছেন আলুর দাম খুব কমবে। আলুচাষি যদি ১২ টাকা প্রতি কেজিতে দাম পান তাহলে চাষের খরচ এবং ন্যায্য লাভ ঘরে তুলতে পারবেন। কিন্তু অধিক ফলনের জন্য দাম বেশি কমলে তাঁর চাষের খরচই হয়তো উঠবে না। অন্যদিকে একজন আলুর বড় ব্যবসায়ী, যিনি ফলনের সময়ে আলুচাষির থেকে প্রচুর আলু কিনে কোল্ড স্টোরেজে মজুত করেন, সারা বছর পাইকার বা বড় খুচরো ব্যবসায়ীকে আলু বিক্রির জন্য, ভাবছেন-ফলন কম হবে, ফলে দাম বেড়ে কেজি প্রতি ১৫-১৮ টাকা হতে পারে জানুয়ারি ২০২২- এ। এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য প্রকল্পিত আলুচাষির সঙ্গে ব্যবসায়ী একটি চুক্তি করলেন যে, তাঁর জমিতে জানুয়ারী ২২-এ যা আলুর ফলন হবে, ব্যবসায়ী ১২ টাকা কেজি দিয়ে কিনে নেবেন। এই চুক্তির পোশাকি নাম ‘ফরওয়ার্ড ট্রেডিং’। এই চুক্তি চাষির পক্ষে খুব সহায়ক কারণ জানুয়ারি ২২-এ বাজার অর্থাৎ Spot Market (স্পট মার্কেট) এ দাম যাই হোক, চাষি নিশ্চিত যে, তিনি চাষের খরচ ন্যায্য লাভ-সহ ঘরে তুলতে পারবেন। স্পট মার্কেট-এ দাম যদি ১২ টাকার বেশি হয় আপনি হয়তো ভাবলেন চাষি লোকসান করলেন, কেননা তিনি ১২ টাকার থেকে বেশি পেতে পারতেন, কিন্তু তিনি চুক্তির মাধ্যমে ন্যায্য লাভ করে নিয়েছেন, বেশি লাভ-এর জন্য তিনি চুক্তি করেননি। চাষিকে আমরা পোশাকি ভাষায় ‘hedger’ বলব। Hedger সেই ব্যক্তি যাঁর উদ্দেশ্য লোকসান বাঁচানো। অন্যদিকে ব্যবসায়ীর সুবিধা, কারণ স্পট মার্কেট-এ দাম ১২ টাকার বেশি হলেও তিনি ১২ টাকা কেজি প্রতি দেবেন কেনার জন্য এবং স্পটে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করতে পারবেন। অর্থাৎ ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য লাভ করা, ফরওয়ার্ড ট্রেডিংয়ে কম দামে কিনে স্পট মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করে। স্পট মার্কেটে কেজি প্রতি দাম ১২ টাকার কম হলে ব্যবসায়ীর লোকসান। এতে লোকসান হবার ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে। কিন্তু Hedger-এর এই ঝুঁকি নেই। তিনি ফরওয়ার্ড ট্রেডিং-এর মাধ্যমে ক্ষতির ঝুঁকি ব্যবসায়ীকে (স্পেকুলেটর) ‘ট্রান্সফার’ করে দিয়েছেন।
ফরওয়ার্ড ট্রেডিং দুই ব্যক্তির মধ্যে হয়। ধরা যাক, এমন একটা বাজার তৈরি করা হল, যেখানে ‘ফরওয়ার্ড কন্ট্রাক্ট’ বেচাকেনা করা যায় তখন সেই বাজার হয়ে যায় ‘ফিউচার মার্কেট’। সেই বাজারে কিন্তু ‘কন্ট্রাক্ট’ বেচাকেনা হয়, কমোডিটি না। কমোডিটি হয়ে যায় underlying অ্যাসেট যার থেকে কন্ট্রাক্টের মূল্য নির্ধারিত হয়। আমাদের উদাহরণ অনুযায়ী underlying অ্যাসেট হচ্ছে আলু। এখানে জানুয়ারি ফিউচার কন্ট্রাক্ট-এর মূল্য হচ্ছে কেজি প্রতি ১২ টাকা। কিছুদিন বাদে দেখা গেল মার্কেট মনে করল, আলুর যোগান আশানুরূপ হবে না জানুয়ারী ২২-এ, ফলে জানুয়ারি ফিউচার-এর বাজার দর দাঁড়াল ১৪ টাকা, উপরোক্ত ব্যবসায়ী জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ১৪ টাকা দরে কন্ট্রাক্টটি বেচে দিয়ে ২ টাকা কেজি প্রতি লাভ করতে পারেন।
কমোডিটি ফিউচার মার্কেট এর বিশেষত্বগুলি নিম্নরূপ :–
১) ফিউচার মার্কেটে কমোডিটি বা দ্রব্যের ডেলিভারি হয় না বললেই চলে, ক্রয় আর বিক্রয় মূল্যের তফাৎ দিয়ে লাভ-লোকসান নির্ধারিত হয়।
২) ফিউচার মার্কেটে কেনাবেচা করতে কোনও সরাসরি বিনিয়োগ দরকার নেই, কিন্তু কন্ট্রাক্টের মূল্য অনুযায়ী ব্রোকারের কাছে মার্জিন মানি জমা রাখতে হয় ফিউচার মার্কেটের নিয়ম অনুযায়ী।
৩) সাধারণত এগ্রি প্রোডাক্ট যেমন সোয়া, রবার ইত্যাদি এবং খনিজ প্রোডাক্ট সোনা, রুপো, কপার, ক্রুড অয়েল ইত্যাদি কেনাবেচা হয় ফিউচার মার্কেটে।
৪) কন্ট্রাক্ট স্পেসিফিকেশন (নির্দিষ্টিকরণ) ফিউচার মার্কেটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন ভারতে অন্যতম কমোডিটি মার্কেট MCX-এ গোল্ড স্পেসিফিকেশন হচ্ছে – বুলিয়ন (অর্থাৎ সোনার বাট )। সর্বনিম্ন কন্ট্রাক্ট size – ১ কেজি। অর্থাৎ কেউ যদি MCX-এ গোল্ড future কিনতে বা বিক্রি করতে চান তাহলে সর্বনিম্ন underlying সোনার পরিমাণ হবে ১ কেজি – ওজন নির্ধারিত হবে সোনার বাটের ওজন অনুযায়ী।
৫) প্রত্যেক কমোডিটির জন্য মার্কেট কন্ট্রাক্ট launching বা শুরু এবং কন্ট্রাক্ট expiry (শেষ) মাস মার্কেট বা এক্সচেঞ্জ ঠিক করে। ফিউচার কন্ট্রাক্ট কিনলে expiry হবার আগেই আপনাকে বিক্রি করে আপনার position close করতে হবে নইলে আপনাকে কমোডিটির ডেলিভারি নিতে হবে। আরআপনি যদি ফিউচার কন্ট্রাক্ট বিক্রি করে থাকেন এবং expiry হওয়ার আগে যদি ফিউচার কিনে position close না করেন, তাহলে সেই কমোডিটি কিনে আপনাকে ডেলিভারি দিতে হবে। ধরুন আজ নভেম্বর ১৫, ২০২১ আপনি দেখলেন সোনার দাম ৪৭০০০ টাকা (১০ গ্রাম) যা আপনার মতে বেশি, পরে দাম কমতে পারে- আপনি গোল্ড ফিউচার বিক্রি করলেন ৪৭০০০ টাকা দামে। উদ্দেশ্য, কম দামে কিনে লাভ করা, যা ফিউচার মার্কেটে করা সম্ভব। কন্ট্রাক্ট expiry, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১-সেইদিন দেখা গেল সোনার দাম প্রতি ১০ গ্রাম ৪৮,০০০ টাকা। আপনাকে সোনা ৪৮,০০০ টাকায় কিনতে হবে position close করার জন্য এবং আপনার লোকসান ১০০০ টাকা। আপনি position close না করলে ওই দামে সোনা কিনে এক্সচেঞ্জকে দিতে হবে।কমোডিটি ফিউচার মার্কেটে বিনিয়োগের কথা ভাবতেই পারেন পোর্টফোলিও ডিভার্সিফিকেশনের কথা মাথায় রেখে।
(লেখক ফাইন্যান্সের অধ্যাপক, জয়পুরিয়া ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, নয়ডা)