shono
Advertisement
Santa Claus

শৈশবের স্বপনবুড়ো! সান্টাক্লজ আসলে সেন্ট নিকোলাস, চেনেন এই দয়ালু মহাপ্রাণকে?

তাঁর কথা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে দেড় হাজারেরও বেশি পুরনো সময়।
Published By: Biswadip DeyPosted: 07:26 PM Dec 28, 2025Updated: 07:27 PM Dec 28, 2025

বিশ্বদীপ দে: সদ্য পেরিয়ে গিয়েছে বড়দিন। এই উৎসবের এক অবিসংবাদী আইকন সান্টাক্লজ। লাল পোশাক, সাদা দাড়ির এক স্বপনবুড়ো। কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনের সঙ্গে কেমন করে জড়িয়ে গেল সান্টা! গভীর রাতে স্লেজগাড়িতে চড়ে যে শিশুদের ইচ্ছেপূরণের কাণ্ডারী হয়ে ওঠে! সেকথা বলতে গেলে আগে চিনে রাখা দরকার সেন্ট নিকোলাসকে। মনে হতেই পারে তিনি আবার কে? তাঁর সঙ্গে সান্টাবুড়োর সম্পর্কই বা কী?

Advertisement

সেকথা বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে দেড় হাজারেরও বেশি পুরনো সময়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দ। রোমান সাম্রাজ্য তখন মধ্যগগনে। সেই সাম্রাজ্যেরই অংশ ছিল তুরস্কের লিসিয়া প্রদেশের অন্তর্গত পাতারা। মনে করা হয় সেই বন্দরনগরীতেই ওই সময় জন্মগ্রহণ করেছিল নিকোলাস। সেই শিশুর বাবা রীতিমতো ধনী ব্যবসায়ী। অল্প বয়সেই মা-বাবাকে হারায় সে। একদিকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধনসম্পদ। অন্যদিকে অনাথ হওয়ার গভীর বিষণ্ণতা। জীবন নামক আশ্চর্য মুদ্রার দুই পিঠে থাকা সুখ ও দুঃখকে তাই খুব অল্প বয়সেই বুঝে ফেলেছিল নিকোলাস। অচিরে তিনিই হয়ে ওঠেন সেন্ট নিকোলাস। তবে সেটা অনেক পরে। যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল প্রায় ছোটবেলা থেকেই। নিজের ধনসম্পত্তি অক্লেশে বিলিয়ে দিতেন তিনি। কাউকে অসহায় দেখলে, বিষণ্ণ দেখলে, দারিদ্রের ছোবলে বিভ্রান্ত হতে দেখলে সেই মুখে হাসি না ফুটিয়ে তিনি থামতেন না।

এমন মানুষের নাম ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যদিও নিকোলাস চাইতেন না দাতা হিসেবে তাঁর নাম জানা যাক। কেননা খ্রিস্টীয় দর্শন তাঁকে শিখিয়ে ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পথ। তিনি সেই পথেই হাঁটতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে তৈরি হল এক কিংবদন্তি। সেন্ট নিকোলাস নামের এক মহাপ্রাণ দাতার কাহিনি!

শৈশবেই মা-বাবাকে হারানো ছোট্ট নিকোলাসকে বড় করে তোলেন তার কাকা। কুড়ি কোঠা পেরনোর পরে (কোনও কোনও মতে আরেকটু পরে) নিকোলাস বিশপ হলেন। এর নেপথ্যেও ছিল এক মজার কাহিনি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সামনের দরজা ঠেলে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবেন তিনিই হবেন পরবর্তী বিশপ। নিকোলাস দরজা খুলতেই নির্ণিত হয়ে যায় তিনি পাবেন সেই পদ। অবশ্য অন্য কাহিনিও শোনা যায়। নিকোলাসের জেরুজালেমে গিয়ে সেখানকার এক গুহাতেই নির্জনে প্রার্থনা করেছিলেন দিনের পর দিন। আরেকটা গল্প হল, নিকোলাস যে শহরে বিশপ হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সেই মাইরা (আজকের ডেমরে) শহরের দেবী আর্টেমিসের সঙ্গে তাঁর লড়াই হয়েছিল। তবে এতরকম গল্পকথার কোনটা কতটা সত্যি তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু নিকোলাসের অস্তিত্ব নিয়ে নেই। একই সঙ্গে তর্ক চলে না তাঁর দানশীলতার মহান অভ্যাস নিয়েও।

সেন্ট নিকোলাসের দানশীলতার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনিটি বলা যাক। একটি পরিবারের তিন মেয়ের বিয়ের যৌতুকের জন্য যথেষ্ট অর্থ ছিল না। তাঁরা যখন ঘুমন্ত তখন নিকোলাস সেখানে তিনটি সোনার থলে রেখে আসেন। কোনও কোনও মতে সেটা তিনি চিমনির দিকে ছুড়ে দেন। এবং সেগুলি সব চিমনি দিয়ে গলে ঘরে রাখা মোজার ভিতরে ঢুকে যায়। সকালে উঠে এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হন সকলে। আবার কারও মতে, একবারে তিনটি থলে তিনি দেননি। একেকটি মেয়ের বিয়ের আগে একটি করে স্বর্ণমুদ্রায় ঠাসা থলে উপহার দিয়ে এসেছিলেন। আরেকটি কাহিনি হল, পরপর তিন রাত অন্ধকার রাতে জানলা দিয়ে (চিমনি নয়) একটি করে সোনায় ভরা থলে তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন। তবে যেভাবেই দিয়ে থাকুন পরিবারটিকে কার্যত রক্ষা করেছিলেন নিকোলাসই। অন্যথায় বৈবাহিক জীবন নয়, দেহব্যবসার পথেই হাঁটতে বাধ্য হতেন ওই তিন তরুণী।

১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ আধুনিক ডেমরে শহরের বুক খুঁড়ে অনেক তলায় খুঁজে পেয়েছিলেন সেই চার্চের মেঝে, যেখানে একসময় হেঁটে বেড়িয়েছেন সেন্ট নিকোলাস। ৩৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নিকোলাসের প্রয়াণের পর মাইরার ক্যাথিড্রালে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। আজ যা খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের এক প্রিয় গন্তব্য। ১০৮৫ সালের দিকে সেলজুক তুর্কিরা যখন অঞ্চলটি জয় করে, তখন ইউরোপের খ্রিস্টানরা আশঙ্কা করেছিল যে সাধুর দেহাবশেষ অপবিত্র করা হতে পারে। আর তাই ১০৮৭ সালে ইটালির বারি থেকে আসা নাবিকরা গির্জায় জোর করে প্রবেশ করে সমাধিটি ভেঙে ফেলে। নিকোলাসের দেহাবশেষ নিজেদের শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তারা। প্রায় এক দশক পর ভেনিসের আক্রমণকারীরা এসে অবশিষ্ট যা কিছু ছিল, তা দখল করে। আর এই চুরির ঘটনাটি নিকোলাসের শেষ বিশ্রামস্থল নিয়ে শত শত বছরের এক বিবাদের জন্ম দেয়। বারি শহর যেমন একটি ব্যাসিলিকা নির্মাণ করে নিকোলাসের দেহাবশেষ রাখতে, তেমনই ভেনিসও করে। আজ অবশ্য তাঁর অস্থির টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ইউরোপে। তুরস্কের আন্তালিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরেও সংরক্ষিত রয়েছে একটি অংশ!

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে সেন্ট নিকোলাস, তাঁর অপার দানশীলতা, মোজায় উপহার দেওয়া... সবই হল। কিন্তু সান্টা কোথা থেকে এল? তুরস্কের এক প্রাচীন বিশপ থেকে তাঁর গ্লোবাল আইকন হয়ে ওঠা কিন্তু একদিনে হয়নি। মধ্যযুগে ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় সেন্ট ছিলেন নিকোলাস। কেবল ইংল্যান্ডেই তাঁর নামে ৪০০টিরও বেশি গির্জা উৎসর্গ করা হয়েছিল। এরপর মার্কিন মুলুকেও পৌঁছে যায় নিকোলাসের নাম।

১৮০৯ সালে ওয়াশিংটন আরভি 'নিকাবকার্স হিস্ট্রি অফ নিউ ইয়র্ক' নামের বইয়ে উল্লেখ করলেন সান্টা ক্লজের কথা। সেখানে নিকোলাসের ছায়াই ছিল। যদিও চেহারায় একেবারেই আলাদা। স্থূলকায় আমুদে এক বুড়ো সে। সান্টা ক্লজ নামটি এসেছে নিকোলাসের ডাচ নাম 'সিন্টার ক্লাস' থেকে। পরে ১৮২৩ সালে প্রকাশিত হয় অধ্যাপক ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুরের কবিতা 'আ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস', যা 'টওয়াজ দ্য নাইট বিফোর ক্রিসমাস' নামে বেশি পরিচিত। সেখানেই দেখা মিলল আটটি বলগা হরিণের। যারা সান্টার স্লেজগাড়ি বয়ে নিয়ে যায়।

এরপর ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৬ সালের মধ্যে শিল্পী থমাস ন্যাস্ট 'হার্পার'স উইকলি'তে আঁকা ছবির মাধ্যমে সান্টার মজাদার চেহারাটিকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। জানা যায়, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গৃহযুদ্ধের সময় সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্য তাঁকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ন্যাস্টের বর্ণনাতেই সান্টা উত্তর মেরুর বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

তবে ১৯৩০ নাগাদ কোকাকোলা বড়দিনের বিজ্ঞাপন বানাতে বিখ্যাত শিল্পী হ্যাডেন সান্ডব্লুমকে বরাত দেয়। তিনিই সান্টার পোশাককে লাল রঙের করেন। এর আগে তাঁর পোশাক ছিল গাঢ় সবুজ রঙের। অনেক ক্ষেত্রে আবার মাটির মতো খয়েরি পোশাকেও দেখা যেত সান্টাকে। যাই হোক, সেই সময় থেকেই সান্টা আজকের পরিচিত চেহারাটি পান। কেবল খ্রিস্টান নয়, পৃথিবীর সমস্ত বাচ্চা ছেলেমেয়েদের তিনি স্বপনবুড়ো। যাঁর ছায়ায় রয়ে গিয়েছেন কবেকার এক দয়ার্দ্র বিশপ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনের সঙ্গে কেমন করে জড়িয়ে গেল সান্টা, গভীর রাতে স্লেজগাড়িতে চড়ে যে শিশুদের ইচ্ছেপূরণের কাণ্ডারী হয়ে ওঠে!
  • সেকথা বলতে গেলে আগে চিনে রাখা দরকার সেন্ট নিকোলাসকে।
  • তাঁর কথা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে দেড় হাজারেরও বেশি পুরনো সময়।
Advertisement