সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: লোকসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেশজুড়ে ইন্ডিয়া জোটের শোচনীয় হারের আভাস দিয়েছিল প্রায় সব বুথফেরত সমীক্ষা। খাতায়কলমে হার হয়তো হয়েছে। তবে তা কোনওভাবেই শোচনীয় নয়, বরং প্রতি মুহূর্তে এনডিএ শিবিরের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলেছে ইন্ডিয়া জোট। এমনকী উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য, যেখানে বিজেপির বিরাট জয়ের আভাস দিয়েছিল সমীক্ষক সংস্থাগুলো, সেখানে যথেষ্ট খারাপ ফল গেরুয়া শিবিরের। খোদ মোদির কেন্দ্র বারাণসীতে শুরু থেকে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী অজয় রাই। সব মিলিয়ে, ২০২৪-এর নির্বাচনে(Lok Sabha Election Result 2024) হেরে গিয়েও 'বাজিগর' হিসেবে ফিরে এসেছে বিরোধী শিবির।
ইন্ডিয়া জোটের এই সাফল্যের পিছনে উঠে আসছে একাধিক কারণ:
জোটের রসায়ন
লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে ইন্ডিয়া জোট গঠনের পর শুরুতে আসন ভাগাভাগি নিয়ে টানাপোড়েন তৈরি হলেও, শেষ পর্যন্ত 'বিগ ব্রাদার' সুলভ মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে আঞ্চলিক দলগুলিকে তাদের মতো লড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয় কংগ্রেস। যার ফলে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রর মতো রাজ্যগুলিতে যেখানে যে শক্তিশালী, সেই সমীকরণে হয় আসন ভাগাভাগি। যার সাফল্যও পায় 'ইন্ডিয়া'। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য তৈরি হলেও তা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে ফেলা হয়। এমনকী বাংলায় তৃণমূল বিরোধিতার জন্য অধীর চৌধুরীর মতো নেতাকেও কড়া সুরে সতর্ক করা হয় কংগ্রেসের তরফে। ফলে শক্তিশালী বিজেপির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সতর্ক পায়ে হেঁটেছে 'ইন্ডিয়া' শিবির। ভোটের ফলাফলে যার সুফলও নজরে পড়েছে।
[আরও পড়ুন: মেলেনি কুলার, বার বার নেওয়া হচ্ছে ওজন! তিহাড়ে কেজরির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আপের]
ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ
এক দিকে বিজেপি যখন কট্টর হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে মাঠে নেমেছে, সেখানে বিরোধী শিবিরকে বারবার বলতে শোনা গিয়েছে, মানুষের পাশে থেকে মানুষের স্বার্থে কাজ করতে চায় তারা। এক্ষেত্রে বেকারত্ব, সমাজে পিছিয়ে পড়া সমাজের স্বার্থে কাজ করার বার্তা দেয় 'ইন্ডিয়া'। যুব সমাজ ও মহিলাদের জন্য ঢালাও প্রতিশ্রুতির বার্তা দেওয়া হয়। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই নির্বাচনের আগে ৪০০ পারের স্লোগান দিয়ে দেশের সংবিধান বদলের বার্তা দেয় বিজেপির কোনও কোনও নেতা। যার পালটা সংবিধান রক্ষার বার্তা দেয় ইন্ডিয়া জোট। ২০২৪-এর লড়াইকে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই হিসেবে তুলে ধরা হয়। বার্তা দেওয়া হয়, এজেন্সি-রাজনীতির পালটা স্বশাসিত স্বংস্থাগুলোকে রক্ষার।
[আরও পড়ুন: ফের একবার মোদি সরকার! ৫০০ বছর আগে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কালদ্রষ্টা নস্ট্রাদামুস?]
'মায়া'র খেলা কাজ করেনি
উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন মায়াবতী। একইসঙ্গে ছাই দিয়ে গেলেন বিজেপির বাড়া ভাতে। এবার উত্তরপ্রদেশের সব কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছিল মায়াবতীর বিএসপি। উদ্দেশ্য ছিল দলিত ভোট নিজেদের দিকে টানা। তবে মায়ার খেলা এবার কার্যকর হয়নি। লোকসভা নির্বাচনে একদিকে যখন ৪০০ পারের স্লোগান দিয়ে সংবিধান বদল ও হিন্দুরাষ্ট্রের ছবি আঁকতে শুরু করে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের এই ছবিটা রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম ও দলিতদের মধ্যে। দলিত ও মুসলিম ভোট একচেটিয়া ভাবে পড়ে কংগ্রেস ও সপায়। শুধু তাই নয়, বিএসপির তরফে কোথাও ব্রাহ্মণ প্রার্থী তো কোথাও রাজপুত প্রার্থী দেওয়ার ফলে আদতে তা ক্ষতির কারণ হয় বিজেপির জন্য। অন্যদিকে, ক্ষমতায় এলে রাজ্যে রাজ্যে জাতিগত জনগণনার বার্তা দেয় ইন্ডিয়া জোট। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে ইন্ডিয়া জোটের বার্তা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। নির্বাচনের ফলাফলে ইতিমধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
রিজিওনাল রেজিস্ট্যান্স
জোট কোনওভাবেই সফল হবে না, ৪০০ পারের স্লোগান তুলে বিরোধী জোটকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের আবহ তৈরি করেছিল বিজেপি। তবে তাতে বিভ্রান্ত না হয়ে নিজেদের লক্ষ্য স্থির রাখে বিরোধী শিবির। জোটের অন্দরে তৈরি হয় রিজিওনাল রেজিস্ট্যান্স। যে সব রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটের আসন ভাগাভাগি হয় সেখানে বিরোধী শিবিরের রসায়ন ভালমতো নজরে পড়ে। কোনওরকম দলাদলি যাতে না হয় সেদিকে যথেষ্ট সতর্ক ছিল ইন্ডিয়া। যার ফল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট, বেশিরভাগ রাজ্যেই নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছে জোট। উদাহরণ স্বরূপ উত্তরপ্রদেশে সপা পেয়েছে ৩৪টি আসন, কংগ্রেস পেয়েছে ৬টি আসন। মহারাষ্ট্রেও বিজেপি যেখানে ১১টি আসন পেয়েছে সেখানে কংগ্রেস পেয়েছে ১২টি, উদ্ধবের শিবসেনা ১০টি ও এনসিপি ১টি আসন পেয়েছে। এদিকে জোটের মধ্যে থেকেও আসন ভাগাভাগির পথে না হেঁটে দারুন ফল করেছে বাংলায় তৃণমূলও। মোদির বিরুদ্ধে প্রচারেও রীতিমতো ঝড় তুলতে দেখা যায়, রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদব, তেজস্বী যাদবের মতো নেতাদের। এমনকী গান্ধীগড় পুনরুদ্ধারে গোটা নির্বাচনে আমেঠি ও রায়বরেলিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও।
মোদির উগ্র হিন্দুত্ব
দেশব্যাপী প্রচারে উগ্র হিন্দুত্ব ও মুসলিম বিরোধিতার ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মুসলিমদের উদ্দেশে 'অধিক সন্তান প্রসবকারী', কংগ্রেসের ইস্তেহার নিয়ে মিথ্যাচার ভালভাবে নেয়নি দেশের জনতা। শুধু তাই নয়, সংবিধান বদলের বার্তা বুমেরাং হয়ে ওঠে বিজেপির জন্য। দলিত ভোট একচেটিয়াভাবে বিজেপির সঙ্গ ছাড়ে। যার সুফল হাতেনাতে পেয়েছে ইন্ডিয়া জোট। মুসলিম ও দলিতদের ভোট পড়েছে ইন্ডিয়া জোটে।